১০ বছর আগের কথা। এক ইফতার পার্টিতে বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ-সালমান, দুই খানের ঝগড়া মিটিয়েছিলেন তিনি। যখনই কোনো তারকা বিপাকে পড়েছেন, তিনি সবার পাশে দাঁড়িয়েছেন। শাহরুখ-সালমানসহ কেউ যার পার্টির আমন্ত্রণ কখনো উপেক্ষা করতেন না, শত কাজ ফেলেও ছুটে আসতেন তার এক ডাকে। তিনি বাবা সিদ্দিকি, মহারাষ্ট্রের জনপ্রিয় রাজনীতিক। বিনোদন জগতের সবার সঙ্গে নিত্য উঠাবসা ছিল তার।
শুধু শাহরুখ-সালমনই নয়, সঞ্জয় দত্তের সঙ্গেও রয়েছে তার খুব ঘনিষ্ঠতা। সালমন থেকে শাহরুখ, ক্যাটরিনা থেকে প্রীতি জিনতা—বাবা সিদ্দিকির ইফতার পার্টিতে হাজিরা দিতেন বলিউডের প্রথম সারির তারকারা। এক সময় নিজেও সিনেমার মানুষ ছিলেন। বলিউড ঘনিষ্ঠতা থাকলেও রাজনীতিক হিসাবেই তিনি পরিচিতি পেয়েছেন বেশি।
শনিবার (১২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় পূর্ব বান্দ্রায় ছেলের অফিসের বাইরে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান বিপুল সম্পত্তির মালিক বাবা সিদ্দিকি।
শাহরুখ ও সালমানের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল দীর্ঘসময়। ২০০৮ সালে ক্যাটরিনার জন্মদিনের পার্টিতে এক ঝগড়া থেকে ‘করণ-অর্জুন’ সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। সব দূরত্ব ভুলে ২০১৪ সালে বাবা সিদ্দিকির ইফতার পার্টিতে সালমানকে বুকে টেনে নেন শাহরুখ। দুই তারকার ভক্তদের হৃদয়ে সেই ছবি আজও গাঁথা রয়েছে। এরপর বহুবার বাবা সিদ্দিকির পার্টিতে এক ফ্রেমে দেখা গেছে দুই খানকে।
বাবা সিদ্দিকি তখন বান্দ্রা পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক। সালমান ও শাহরুখের মধ্যে বিবাদ মেটাতে মধ্যস্থতা করার জন্য বলিউডের ভেতর থেকেই সিদ্দিকিকে অনুরোধ করা হয়। ‘সূক্ষ্ম উপায়’ বের করে দুই বন্ধুর দ্বন্দ্ব মেটাতে ভূমিকা রাখেন এই রাজনৈতিক নেতা।
তার ইফতার পার্টিতে শাহরুখের পাশে বসেছিলেন সালমানের বাবা বর্ষীয়ান চিত্রনাট্যকার সেলিম খান। সালমান পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে শাহরুখ ও সেলিম খান গল্প করছিলেন। সালমন হেঁটে টেবিলের কাছে আসতেই শাহরুখ উঠে দাঁড়ান এবং একে অপরকে আলিঙ্গন! এক নিমিষেই দুই খানের সম্পর্কের বরফ গলল।
কে এই বাবা সিদ্দিকি
২০২২ সালের এপ্রিলে বাবা সিদ্দিকির ইফতার পার্টিতে বলিউডের চাঁদের হাট বসেছিল। শাহরুখ, সালমন তো বটেই, সঞ্জয় দত্ত, রাকুল প্রীত সিং, সদ্য মিস ইউনিভার্সজয়ী হরনাজ সিং সান্ধু, কে ছিল না সেই পার্টিতে! বরাবরের মতে চেনা ছন্দে, বিপুল জাঁকজমকে জমে উঠেছিল সেই সন্ধ্যা। কিন্তু কে এই বাবা সিদ্দিকি? কেন তার পার্টি মানেই বলিউড তারকাদের হইহই রইরই কাণ্ড?
বলিউডের সঙ্গে বাবা সিদ্দিকির সরাসরি যোগ নেই। তিনি খাঁটি রাজনীতিবিদ। মহারাষ্ট্রের পশ্চিম বান্দ্রা কেন্দ্র থেকে তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন তিন-তিন বার। কংগ্রেসের এই বর্ষীয়ান নেতা ১৯৯৯, ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে পরপর তিন বার ভোটে জিতেছেন। তবে রাজনীতির আঙিনায় বাবা সিদ্দিকির জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে গেছে তার বলিউডি জনপ্রিয়তার কাছে। বলিউডে বাবা সিদ্দিকি মানেই ঝলমলে পার্টি আর সেখানে তারকাদের চাঁদের হাট।
বাবা সিদ্দিকি বরাবরই বি-টাউনের স্টারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। প্রভাবশালী এই নেতার সঙ্গে একে একে ভাব জমিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রির সকলেই। সঞ্জয় দত্ত তো তার বিশেষ ঘনিষ্ঠ বলে শোনা যায়। বছরের পর বছর ধরে বাবা সিদ্দিকির পার্টি বলিউডে একটা ট্রেন্ডের জন্ম দিয়েছে। নিজেদের স্ট্যাটাস বজায় রাখতেই তার পার্টি বা যে কোনও বড় ইভেন্টে হাজির হন সেলেব্রিটিরা। এত জমকালো পার্টির হাতছানি কেউ বড় একটা উপেক্ষা করেন না।
নিন্দুকেরা বলেন, বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে যে সমস্ত কলাকুশলীর মান সম্ভ্রমে কখনো না কখনো কালি লেগেছে, কোনও না কোনও বিতর্কে যারা একবার হলেও জড়িয়েছেন, তাঁরাই বাবা সিদ্দিকির অধিক ঘনিষ্ঠ। এঁদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে বাবাজির।
সত্তরের দশকে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন থেকে মূল স্রোতের রাজনীতিতে এসেছিলেন সিদ্দিকি। ১৯৯৯ সালে প্রথম বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন বান্দ্রা এলাকার এই নেতা। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে সাবেক কংগ্রেস-ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) জোট সরকারের খাদ্য ও নাগরিক সরবরাহ, শ্রম, খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এবং ভোক্তা সুরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৯ সাল পর্যন্ত তিন বার ভোটে জিতলেও ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে বান্দ্রা পশ্চিম কেন্দ্র থেকে তিনি হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার ছেলে জিশান এখন বান্দ্রা পূর্বের বিধায়ক। গত ফেব্রুয়ারিতে কংগ্রেসের সঙ্গে পাঁচ দশকের সম্পর্ক ছিন্ন করে অজিত পাওয়ারের এনসিপিতে যোগ দেন বাবা সিদ্দিকি।
যেভাবে খুন হলেন বাবা সিদ্দিকি
বিজয়া দশমীর দিন বান্দ্রায় বাবা সিদ্দিকির অফিসের কাছে বাজি ফাটাচ্ছিল অনেকে।
শনিবার রাত সোয়া ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে বাবা সিদ্দিকি তার ছেলের অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন। আতশবাজির বিকট শব্দের মধ্যে মুখে রুমাল বেঁধে থাকা তিনজন হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে পরপর ৬ রাউন্ড গুলি চালায়। এর মধ্যে বাবা সিদ্দিকির তিনটি গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা সিদ্দিকি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
তাকে লীলাবতী হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই হামলায় পুলিশ এখনও পর্যন্ত ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, আরও একজনের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে। এ ঘটনার পর রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। সামনেই মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন।