দেশের সিনেমার মন্দাভাব আর কাটছেই না। সিনেমায় প্রথম ধাক্কা লাগে করোনাকালে। সেই ধাক্কা কাটতে না কাটতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে আরেকবার বিপাকে পড়েছে সিনে ইন্ডাস্ট্রি। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, আওয়ামী সরকার পতন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, সব মিলিয়ে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত খুব বেশি নতুন ছবি মুক্তি পায়নি।
১৫ নভেম্বর ‘দরদ’ দিয়ে ফের সরব হয়েছিল সারা দেশের হলগুলো। খুব একটা লাভ হয়নি। নভেম্বরের শেষদিকে মুক্তি পেল বিপ্লব হায়দারে ‘ভয়াল’ কিন্তু সাড়া জাগাতে পারেনি। ডিসেম্বরে এসে ছবি মুক্তি পেল সোহেল রানা বয়াতি পরিচালিত ‘নয়া মানুষ’, সাইফ চন্দনের ‘দুনিয়া’, কিন্তু কোনো ছবিই টানতে পারছে না দর্শক। সঙ্গত কারণে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ‘মধুমিতা’ ২৮ নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে।
এই নিয়ে ‘মধুমিতা’র কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, ‘মানহীন সিনেমা মুক্তির কারণে হল বন্ধ রেখিছি। আমার হলের একটা সুনাম আছে। সেটা নষ্ট করতে চাই না। ছবির পোস্টার দেখলেই মানুষ বুঝে যায়, কেমন ছবিটি। মানহীন ছবি চালালে আমাদের এত দিনের ঐতিহ্য নষ্ট হবে। যে কারণে দরদ’-এর পর আর কোনো ছবি আমাদের হলে চালাইনি।
তিনি বলেন “নির্মাতারা এ ধরনের ছবি কেন করেন, প্রযোজকরাও কেন লগ্নি করেন? আমিও তো প্রযোজনা করেছি। প্রায় প্রতিটি ছবি ব্যবসাসফল। আগে এই পেশা সম্পর্কে জানতে তো হবে। টাকা হয়েছে আর নির্মাণ করে ফেললাম এই ধরনের মানসিকতার কারণে আমাদের সিনেমা ব্যবসায় ধস নেমেছে। সত্যি বলতে, আমাদের সিনেমার ভবিষ্যৎ কী? কেউ কি জানেন? যারা এখন সিনেমার সঙ্গে আছেন তারাও মনে হয় জানেন না।”
২৯ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছিল বিপ্লব হায়দারের ‘ভয়াল’। ইরফান সাজ্জাদ ও আইশা খান অভিনীত ছবিটি চলেছে ১৭টি হলে। খুলনার সংগীতা হলে প্রথম দিন মোটামুটি দর্শক হলেও পরদিন থেকে একেবারে দর্শকখরা। শুধু সংগীতা নয়, দেশের অন্যান্য হলেও ছবিটি দর্শক টানতে পারেনি সেভাবে। ফলে দ্বিতীয় সপ্তাহেই ছবিটি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, জানিয়েছেন বুকিং এজেন্ট এস কে শামীম।
তিনি ছয়টি হলে ছবি বুকিং করেন। শামীম বলেন, ‘দর্শক হলেই আসতে চায় না। শাকিব খানের ছবি ছাড়া টাকা তোলা যায় না বললেই চলে, তবে শাকিব খান অভিনীত ‘দরদ’ও খুব একটা চলল না। এমনিতে গত চার মাসে ছবি মুক্তি পায়নি। ভেবেছিলাম নভেম্বর-ডিসেম্বর মিলে হল ব্যবসা আবার চাঙ্গা হবে। তবে যে সব ছবি মুক্তির তালিকায় আছে সেগুলোর তালিকা দেখে হতাশ হয়েছি।’
শামীমের মতো একই কথা বললেন দেশের ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ‘মণিহার’-এর বুকিং এজেন্ট আলী আকবর সোহাগ। ‘ভয়াল’, ‘নয়া মানুষ’ ও ‘দুনিয়া’ গত সপ্তাহ ও এ সপ্তাহে পর পর তিনটি নতুন ছবি মুক্তি পেলেও তিনি যশোরের মণিহারে তোলেননি একটিও। বরং এই সপ্তাহে চালাচ্ছেন ২০১৮ সালের যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘ভাইজান এলো রে’।
সোহাগ বলেন, ‘দর্শক এখন ছবির পোস্টার দেখেই সিদ্ধান্ত নেয় কোনটা দেখবে আর কোনটা দেখবে না। তা ছাড়া এখন প্রত্যেকের হাতে স্মার্ট ফোন। প্রতিদিনই নতুন নতুন ছবি ইউটিউবে মুক্তি পাচ্ছে। সেসব রেখে তাদের হলে আনতে হলে ভালো মানের ছবি লাগবে।
‘পুষ্পা ২’ দ্য রুল’-এর একটা দৃশ্যের সমান কি আমাদের পুরো ছবি হবে? শাকিব খানকে নিয়ে মামুন ‘দরদ’ নির্মাণ করেছেন। প্যান ইন্ডিয়ান ছবি বলে গলা ফাটিয়েছেন। অথচ ইন্ডিয়াতে ছবিটি মুক্তিই দিতে পারলেন না! ‘দরদ’ নিয়ে অনেক হল মালিক ঠকেছেন। হল মালিকরা এখন আগে নিজেরা ছবি দেখতে চান। যদি মনে হয় চলবে, তবেই শুধু চালাবেন।’
ছবি চলছে না তবু এ মাসের বাকি তিন সপ্তাহে মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন আট ছবির নির্মাতা। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তির অপেক্ষায় আছে দুই ছবি—‘ডেঞ্জার জোন’ ও ‘হুরমতি’। ‘ডেঞ্জার জোন’-এর শুটিং হয়েছিল ২০১৮ সালে। বেলাল সানীর এই ছবিতে অভিনয় করেছেন বাপ্পী চৌধুরী ও ফাল্গুনি রহমান জলি। অন্যদিকে শবনম পারভীনের ‘হুরমতি’র শুটিং হয়েছিল ২০১৯ সালে। ছবিতে শবনম পারভীনের সঙ্গে আছেন ছয় নায়ক—শ্রাবণ শাহ, সমাপ্তি মাশুক, সনি রহমান, নিলয়, অভি ও টুকু।
পরের সপ্তাহে (২০ ডিসেম্বর) মুক্তি পাওয়ার কথা তানভীর হাসানের ‘মধ্যবিত্ত’ ও শফিক হাসানের ‘বাহাদুরি’। এই দুটি ছবিও বেশ আগের। ‘বাহাদুরি’র শুটিং শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। অভিনয়ে জায়েদ খান ও মৌ খান। অন্যদিকে ‘মধ্যবিত্ত’র শুরু হয়েছিল ২০২১ সালে। অভিনয়ে ওমর মালিক ও এলিনা শাম্মী। ছবিটি সেন্সর বোর্ডেও দীর্ঘদিন আটকে ছিল। একই দিনে শঙ্খ দাশগুপ্তের ‘প্রিয় মালতী’ও মুক্তি পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে এখনো প্রযোজক সমিতিতে ছবিটির নাম নিবন্ধন করা হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অফিস কর্মকর্তা সৌমেন সুর।
২৭ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে তিন ছবি—আব্দুল মান্নানের ‘কিশোর গ্যাং’, জেসমিন আক্তার নদীর ‘জল শ্যাওলা’ ও মেহেদী হাসানের ‘ক্ষত’। তিনটি ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীই নতুন। ফলে দর্শক টানতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় ভালো গল্প ও নির্মাণ হলে দর্শক ছবিটি গ্রহণ করে। তবে বাংলাদেশের দর্শক তারকানির্ভর ছবিই দেখতে চায় বেশি। এ মাসে যে ছবিগুলো মুক্তি পেতে যাচ্ছে তার কোনোটিই কিন্তু সম্প্রতি নির্মিত হয়নি। কোনোটি ছয় বছর, আবার কোনোটি চার বছর আগের। এই ধরনের ছবি থেকে তো আগেই দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেবে। আমি নিজেই প্রযোজক-পরিচালক। অনেক ছবি করেছি। সেদিক থেকে প্রযোজক-পরিচালকদের কষ্টটা বুুঝি। হয়তো আর্থিক কারণে ছবিগুলো আটকে ছিল। নইলে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায়নি এমনও হতে পারে।
এখন হয়তো কোনো রকমে মুক্তি দিতে চাইছে। কিছু টাকা হলেও তো পাবে—এই আশা করছে। তবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন হল মালিকরা। তারা তো একটা টাকা দিয়ে ছবিগুলো প্রদর্শনের জন্য নেন। সেই টাকা তো পরে আর ওঠে না। আমাদের সিনেমা এখন ভয়াবহ হুমকির মুখে।’