সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি নাম। অনন্য সৌন্দর্যের সঙ্গে ভুবনভোলানো আবেদনময় মিষ্টি হাসি আর অসাধারণ অভিনয়শৈলীর কারণে সুচিত্রা সেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মন জয় করেছেন। আজ ১৭ জানুয়ারি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের নবম প্রয়াণ দিবস।
সুচিত্রা সেন নায়িকাদের নায়িকা, মহানায়িকা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আজ অবধি বাংলার মডেল কিংবা নায়িকারা সুচিত্রা সেনকে আইডল করে তার মতো শাড়ি পরেন, হাতাকাটা ব্লাউজ পরেন, চোখে কাজল টানেন, চুলে কখনো বেণী বাঁধেন কখনো বা খোঁপা সাজান কিংবা ঘাড় বাঁকিয়ে রোমান্টিক চাহনি দেন।
একজন সত্যিকারের সুপারস্টার জানতেন, জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতেই লাগাম টেনে ধরতে হয়, কখন থামতে হয়। সুচিত্রা সেন-ই জনপ্রিয়তার চূড়ায় যাওয়া সেই কিংবদন্তি নায়িকা, যিনি কেবল নিজের লাগাম টেনেই ধরেননি, অনন্ত যৌবনা ও তুমুল সম্মোহনী রূপের সৌন্দর্য দর্শক হৃদয়-মনের গভীরে গেঁথে দিয়ে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়েছেন।
সুচিত্রা সেন সারা জীবন নিজের আশপাশে এক অদ্ভুত দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে রাখতে পেরেছিলেন, তা ভেদ করার কথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারেনি। এমন অসম্ভব সাহসী, বেপরোয়া এবং দৃঢ়চেতা একজন সেলিব্রিটি সে যুগে বিরল ছিল। শুধু সে যুগে কেন? যুগে যুগে তার মতো সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা, দাপুটে অভিনেত্রীর জুড়ি মেলা ভার। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজ ব্যক্তিত্বের বলে বলীয়ান কজন হতে পারে?
তাকে নিয়ে যত না আলোচনা, যত না প্রশংসা, যত না বিশ্লেষণ, তার চেয়ে বেশি মিথ হয়ে ঘুরে-ফিরে আসে; যেন অনন্তকালের চিরযৌবনা রূপবতী সুচিত্রা সেনের মৃত্যু নেই। ভারত উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়িটি দীর্ঘদিন পর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের দখল থেকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে পাবনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ওই বাড়িটি ‘কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’ করা হয়েছে। পাবনা জেলা শহরের পৌর এলাকার গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়ি। এ বাড়িতেই তার জন্ম। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারি ইন্সপেক্টর।
বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন সুচিত্রা। নবম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় ১৯৪৭ সালে কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার দীবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের ঘরে একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন।
তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ওই বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’। সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানাতে ও তার স্মৃতি রক্ষার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে তোলা সংগ্রহশালায় মহানায়িকার বিভিন্ন ছবি, জীবনের বিভিন্ন তথ্যসংবলিত বিলবোর্ড, পুস্তিকা, সিনেমার পোস্টারসহ রয়েছে নানা নিদর্শন। বাড়ির আঙিনায় সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে সুচিত্রার একটি ম্যুরাল। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে তার বিশালাকৃতির এ প্রতিকৃতি।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন সব ফুলের গাছ। বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে আছে মহানায়িকার স্মৃতি। আর তাতে মুগ্ধ হচ্ছেন আগত দর্শনার্থীরা। সুচিত্রার পৈতৃক এ বাড়িটিকে পূর্ণাঙ্গ আর্কাইভে পরিণত করার দাবি পাবনাবাসীর।
সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ তার এই পৈতৃক বাড়িতে ভিড় জমান। অন্য জেলা থেকে পাবনায় আসা ভ্রমণপিপাসুরা তার বাড়ি দেখতে এসে নিজেদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। আর এ প্রজন্মের তরুণীরা তো সুচিত্রাকে ভাবেন নিজেদের আইডল হিসেবে।
সোমবার সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া প্রতিদিন ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে সংগ্রহশালা। এখানে প্রতিদিন ২০-২৫ জনের বেশি দর্শনার্থী আসেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও কলকাতা থেকেও প্রায়ই দর্শনার্থীরা আসেন। তারা সংগ্রহশালাটি দেখে মুগ্ধ হন, আনন্দিত হন।
দর্শনার্থীদের অভিমত, সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখে। বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। তাদের দাবি, পাবনাবাসীর আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সুচিত্রা সেন। তাকে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার সম্পর্কে জেনেছেন।
তথ্যমতে, ১৯৫২ সালে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রথম পা রাখেন। প্রথম ছবি করেন ‘শেষ কোথায়’। তবে ছবিটি আর মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবি করে সাড়া ফেলে দেন চলচ্চিত্রাঙ্গনে।
সুচিত্রা সেন বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি দেবদাস (১৯৫৫)। সুচিত্রা সেন ১৯৭৮ সালে প্রণয় পাশা ছবি করার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। এর পর থেকে তিনি আর জনসমক্ষে আসেননি। মাঝে একবার ভোটার পরিচয়পত্রে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ছবি তুলতে ভোটকেন্দ্রে যান। সুচিত্রা সেন ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্ত। একবার তিনি গোপনে কলকাতা বইমেলায় গিয়েছিলেন। সে সময় বলিউড-টালিউডের বহু পরিচালক সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইলেও তিনি এতে সম্মত হননি। এমনকি দেশ-বিদেশের কোনো পরিচালক বা অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎও দেননি তিনি। সেই থেকে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যান। যদিও তার বাসভবনে তিনি কেবল কথা বলেছেন, তার একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রিয়া ও রাইমার সঙ্গে।
মহানায়িকার মহাপ্রয়াণ
দীর্ঘদিন অন্তরীণ থাকায় সুচিত্রা সেনের শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। হঠাৎ নিজের লাগাম টেনে ধরেন এই চিরআবেদনময়ী সৌন্দর্যের প্রতীক। প্রয়াণের আগে ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি একটি হাসপাতাল বেলভিউতে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে যান মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।
দিবসের আয়োজন
জেলা প্রশাসন, জেলা শিল্প কলা একাডেমি, সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র সংসদ, টাউন গালর্স হাইস্কুল ও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে দিবস ঘিরে। সুচিত্রা সেন বসতভিটায় এনিয়ে এক স্মরণ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবে রাজশাহীস্থ ভারতীয় দূতাবাসের সহকারী হাইকমিশনার মনোজ্ঞ কুমার। এ ছাড়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, পৌর মেয়রসহ সূধীজনেরা উপস্থিত থাকবেন।