সকালে নাস্তা করতে বেরিয়ে দেখি হুড়মুড় করে তুষার ঝরে পড়ছে। ঠাণ্ডার ভেতর বরফের উপর সাবধানে পা ফেলে গেলাম জার্মান ক্যাফে মঁ শেরির দিকে। মাঝে বাচ্চাদের পার্কটা পুরো সাদা ধবধবে হয়ে আছে বরফ পড়ে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির উপর বরফের মোটা আস্তরণ। এরা রাস্তাঘাট বরফমুক্ত করতে সারারাতই কাজ করেছে। পাঁচ মিনিটের মতো হেঁটে ক্যাফেতে ঢুকতেই ‘আলো’, আমিও বললাম, ‘হ্যালো’। ওদের সাথে আমার ভালোই পরিচয় হয়ে গেছে। নাস্তায় দিতে বললাম পর্কের ভুয়ের্ৎজিগা-ফ্রিকাডেলা (Würzige Frikadelle), ইংরেজিতে বললে স্পাইসি মিটবল। আর সাথে আলুর সালাদ। ক্যাফেতে দেখি ‘চায়ে ল্যাতে’ও বিক্রি করে। দুধ-চা নাম হলেও জিনিসটা বাংলাদেশের চায়ের মতো না। দুধচায়ের একধরনের মিক্সড পাউডার মিল্কশেকের মতো করে বানিয়ে দেয়। তবে গরম গরম খেতে মন্দ না। একটু স্ট্রবেরি ফ্লেবার আছে।
খাওয়াদাওয়া সেরে এক হালি সেদ্ধ ডিম, একেকটা পঞ্চাশ সেন্ট করে, কিনে বাসায় ফিরলাম। লেখাপত্র সেরে বের হওয়ার সময় ভাবছিলাম, এখানে যে রাস্তাঘাট পার হই সিগনালে, এটা অন্ধ মানুষও পার হতে পারবে। কারণ এখানে সবাই ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলে। কেউ রাস্তা খালি পেলেই গাড়ি টান দেয় না। আবার পথচারীরাও আন্দাজে দৌড়ে রাস্তা পার হয় না। স্টেশনে ঢুকে দেখি সত্যি সত্যিই একজন অন্ধ মানুষ দাঁড়িয়ে, একা। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে।
১৫ ফেব্রুয়ারি আমার শিডিউলে দুটি ছবি দেখার কথা। দুই ছবির মাঝে চার ঘন্টার বিরতি। কি করবো এই সময়টাতে তা নিয়ে কিঞ্চিত চিন্তা করতে করতে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলের লবিতে গেলাম। হলিউড রিপোর্টার, দ্য স্ক্রিন আর ভ্যারাইটির বার্লিনালে সংখ্যাগুলো নিয়ে বসলাম সোফায়। একটি একটি করে পাতা উল্টাচ্ছি, আর পছন্দ হলে রিভিউগুলো পড়ছি। এমন সময় পাশে খালি সোফায় বসতে পারবেন কি না জানতে চাইলেন এক ভদ্রমহিলা। বসতে বললাম। আমি কোথায় পত্রিকা পেয়েছি জানতে চাইলেন। স্ট্যান্ড দেখিয়ে দিলাম। এরপর আলাপে জানলাম তিনি লন্ডন ভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রযোজক। নাম ক্রিস্টিন হার্টল্যান্ড। ওরা ‘মাই স্ম্যাশ মিডিয়া’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান করেছে। যেখানে দুনিয়ার যে কোনো প্রান্ত থেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা বা চিত্রনাট্যকার ওদের কাছে গল্পটা প্রস্তাবাকারে তুলে ধরতে পারবে। অর্থকড়ির চিন্তা ওদের। ওরা শুধু চায় গল্পটা নিয়ে এগিয়ে আসুক নবীনদের কেউ। আমি ওদের এই বিজ্ঞাপনটি সাথে সাথে আমার ফেসবুকে দিয়ে দিই।
চলচ্চিত্র উৎসবের এটা একটা সৌন্দর্য্য। এখানে সবাই খোলা মনে সবার সাথে মেশে। আলাপ করে। একে অপরের জন্য জায়গা করে দেয়। ক্রিস্টিন বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমারও উঠতে হবে, সাড়ে তিনটায় ছবি আছে। ফরাসি ছবি ‘আরি’, পরিচালকের নাম লেওনর সেরেইল। ছবিটি কম্পিটিশন সেকশনের। আমি এই প্রথম পার্সপেক্টিভস সেকশনের বাইরের ছবি দেখছি। ছবিটি দেখানো হয় বার্লিনাল পালাস্টে। এটাই ওদের মূল স্ক্রিনিং থিয়েটার। এখানে ছবি দেখানো মানে, পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীরা লাল গালিচায় হেঁটে এসে থিয়েটারে ঢুকবে। এখানে আবার দেখলাম মাঝে বড় বড় পোস্টারে, নিজেদের ছবির নিচে অটোগ্রাফও দিচ্ছে ওরা। ‘আরি’ ছবিটি একটু দেরিতে শুরু হয়। কারণ পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীরা রেড কার্পেটে হেঁটে এসে ভেতরে বসলেন। তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো।
রাজসিক প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় পূর্ণ। সকল আলো নিভিয়ে শুরু হলো ‘আরি’। ২৭ বছরের এক তরুণ আরি, প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষানবিশ শিক্ষক। প্রেমিকা হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে গেলে, হতবিহ্বল হয়ে সে পালায়, কারণ পিতৃত্বের জন্য সে প্রস্তুত নয়। কিন্তু বিষয়টি তাকে গভীর সঙ্কটের ভেতর ফেলে। প্রভাব ফেলে চাকুরি জীবনেও। কাজটা হারায় সে। বাবার ঘাড়ে বোঝা হতে চায় না আরি। বেরিয়ে পড়ে প্যারিস শহরে। বন্ধুদের পুনঃআবিষ্কার করতে শুরু করে। ভাবে বন্ধুরা কে কোথায় আছে খোঁজ নেবে। কিন্তু সেসব বন্ধুদের কাছে গিয়ে দেখে তারা তাদের জীবন নিয়ে হয় বুঁদ, নয় তো অশান্তিতে আছে। বন্ধুরা যেন হয়ে ওঠে তার আয়না। সে নিজেকেই আরো ভালো করে বুঝতে শুরু করে। এরপর শেষ পর্যন্ত সে আবিষ্কার করে তার সন্তানকে। যে সন্তানকে সে খুঁজে পেতে চাইত বিদ্যালয়ের শিশুদের ভেতর। কাব্যিক ঢংয়ে বানানো ছবিটি একেবারেই টিপিকাল ইউরোপিয়ান আর্ট ফিল্ম। মানসিক টানাপোড়েন, জীবন নিয়ে একমুঠো দর্শন, তিন-চারটি কবিতা, দুফোটা সমকামিতা। এই তো। একটা নিটোল গল্প আছে, যা মস্তিষ্কে চাপ তৈরি করে না।
পরের ছবিটি রাত সাড়ে নয়টায়। সেটি বেশ চাপ তৈরি করেছে। সেই কাহিনিতে যাওয়ার আগে বলি রাতের খাবারের গল্প। ভেন্যুর অংশ পটসডেমার পালাস্তে গিয়ে দেখি ৭৫তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষ্যে জার্মান সরকার যে বিশেষ স্মারক ডাকটিকিট বের করেছে সেটা বিক্রি হচ্ছে একটা বুথ থেকে। সকালে খবরটা দেখেছিলাম, কিন্তু পেয়ে যাব ভাবিনি। বারোটি ডাকটিকিটের পুরো শিট ও দুটি পোস্টকার্ড নিলাম। ডাকটিকিট লাগালাম পোস্টকার্ডের উপর, তারপর কাউন্টারে থাকা মেয়েটি বিশেষ সিল মেরে দিল তাতে। সাড়ে নয় ইউরো লাগল। মনের আনন্দে সেটা নিয়ে, মনের জন্য একটা ক্যালাইডোস্কোপ কিনলাম। দাম খুবই কম, পাঁচ ইউরো। এরপর খাইদাই করতে হবে। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। একবারে ‘লিনার’ হয়ে যাক। লাঞ্চ প্লাস ডিনার। সন্ধ্যা সাতটা তো বাজেই।
মলের ভেতরে থাকা বিশাল ফুডকোর্টে গেলাম। এখানে তুর্কি থেকে চীনা, ইটালিয়ান থেকে ইন্ডিয়ান, কি খাবার নেই। আমি কেন জানি ঘুরতে ঘুরতে চীনা ফুডের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। জিয়ান-বিং নামের এক খাবারের চেহারা পছন্দ হলো। মুং বিন ক্রেপে মানে মুগডাল দিয়ে বানানো রুটি, তাতে দুটি ডিম ভেজে বিছিয়ে দিয়ে তার ভেতর মাংসের হ্যাম ও গ্রিন সালাদ, সাথে ক্রিস্পস। আকারে বেশ বড়সড়। দশ ইউরো। না করার আগেই দোকানি ঝাল সস ঢেলে দিল খানিকটা। তো তলানিতে গিয়ে ঝাল জমা হলো। দুই ভাজ করে ত্রিভুজের মতো করা জিয়ান-বিং খেতে ভালো লেগেছে। কিন্তু ঝাল লাগায়, একটু দূরে গিয়ে তিরামিসু কোন আইসক্রিম কেনা হলো। এক স্কুপ দুই দশমিক আশি ইউরো।
তখনো প্রায় দুই ঘন্টা বাকি পরবর্তী ছবি শুরু হতে। শপিং মল থেকে বেরিয়ে গিয়ে গ্র্যান্ড হায়াতের লবিতে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ সুমন চাট্টুজ্যের গান শুনলাম। এরপর লবিতেই দেখা হলো সৌদি ফিল্ম ক্রিটিক আহমেদের সঙ্গে। ‘হ্যালো মাই ফ্রেন্ড’ বলে এগিয়ে এলো। কুশলাদি বিনিময় করে আমি ব্লুম্যাক্স থিয়েটারের দিকে পা বাড়ালাম। এই বাইরেই আসতে ইচ্ছা করে না। এত ঠাণ্ডা। তার ভেতরেও দেখি লোকজন লম্বা লাইন দিয়েছে বার্লিনাল পালাস্টে ঢুকে ছবি দেখবে বলে। ভাগ্যিস তুষারপাত বন্ধ হয়েছে। দুপুরের পর একটু উঁকি মেরেছিলেন সূয্যিমামা। তারপর তিনি ঘুমুতে চলে গেছেন। এদিকে রাত সাড়ে নয়টা বাজে ঘড়িতে, মানে ঢাকায় তখন রাত আড়াইটা। আমার চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। তা নিয়েই গেলাম প্রেক্ষাগৃহে।
ইতালি ও ফিলিপিনের যৌথ প্রযোজনার ছবি। ছবির পরিচালক পাগল কিছিমের। নাম লিরিক দেলা ক্রুজ। এই লোক এই ছবির পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার, এডিটর, কো-রাইটার, কো-প্রোডিউসার, প্রায় সব। পরিচয় দিতে দিতে উপস্থাপক হয়রান হয়ে যাচ্ছিল। তো খুব প্রশংসা করেটরে শুরু করলো ছবিটা। দেখতে দেখতে আমার দফারফা অবস্থা। সাদাকালো ছবি, ক্যামেরা এক জায়গায় বসে আছে। নড়েচড়ে না। না এটাকে বেলা তারের ‘টুরিন হর্সে’র সাথে মিলিয়ে ফেললে হবে না। ওটা আলাদা জিনিস। আর লিরিক দেলা ক্রুজের ‘হোয়ের দ্য নাইট স্ট্যান্ডস স্টিল’ (২০২৫) আলাদা জিনিস। এই ছবিতে এক বৃদ্ধা, ইতালিতে মানুষের বাসায় কাজ করতে করতে বয়সের গাছ পাথর হয়ে গেছে, তো হঠাৎ তার ইতালিয়ান মালকিন প্যাট্রিজিয়া মারা গেছে। প্যাট্রিজিয়ার কেউ ছিল না এই বৃদ্ধা ভৃত্য আতে ছাড়া। আতে এখন ইতালির মতো দেশে বিশাল বাগানবাড়ির মালিক। তো এরই ভেতর তার সেই শুনশান বাড়িতে এসে ওঠে ইতালিতে বসবাসরত তারই ভাইবোন মানি ও রোজা। তারা বুদ্ধি দেয় আতে যেন এই বিশাল বাড়িটি বেঁচে অন্যকিছু করে। কিন্তু মালকিনের স্মৃতি আতে বিক্রি করবে না। এক পর্যায়ে অর্থ সংকটে থাকা আপন ভাই মানি বৃদ্ধা আতেকে খুন করে। অন্ধকার নেমে আসে পর্দায়। এই হচ্ছে গল্প।
কিন্তু গল্পটা যে ঢংয়ে লিরিক বলেছে, সেটা খুবই মজার। লংশটে ধরা ফিক্সড ক্যামেরা। লং টেক। কখনো পিনপতন নিরবতা। কখনো টকিং হেডস। তবে ছবিটার মূল জাদু অন্য জায়গায়। এখানে অভিনয় করা তিনজনই দীর্ঘদিন ধরে ইতালিতে মানুষের বাসায় ভৃত্যের কাজ করছে। কম করে হলেও কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে। তো তারা অন্য দেশে এসে না পারছে নিজের দেশকে ভুলতে, না পারছে বিদেশকে আপন করে নিতে। কিন্তু এটা তো ঠিক, জীবনের একটা বড় সময় ধরে তারা বিদেশকে সার্ভিস দিয়ে যায়। ছবির মাধ্যমে এটাও বলা হয়, বিদেশের মাটিতেই তারা জীবন বলি দিয়ে দেয়। আমাদের স্ক্রিনিংয়ে বার্লিনে নিয়োগকৃত ইতালির রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন।
ছবি দেখানোর পর লিরিক ও তিন অভিনয়শিল্পীর কথা ও অভিজ্ঞতা বেশি উপভোগ্য ছিল। পুরো সিনেমাটা হাল্কা এমেচারিশ মনে হয়েছে। অভিনয়টাও কাঁচা। লিরিকের প্রথম ছবি। তবে অভিনবত্ব আছে স্বীকার করতে হয়। এটা হতে পারে, আমরা যে ধরনের ছবি দেখে অভ্যস্ত, সেসবের বয়ানকে পুনঃউৎপাদন করেনি বলে একটু অস্বস্তি হয়েছে। অথবা এই টিকটক ও রিলসের অস্থির যুগে লিরিকের শান্ত, নিরিবিলি ছবিটি যেহেতু ঘড়ির কাটাকে থমকে দেয়, সেজন্য আমার বেচইন লেগেছে। তবে এই ছবির ভেতর নীরিক্ষা করার যে ঝোঁক রয়েছে সেটি ধন্যবাদার্হ। সেজন্যই শুরুতে বলছিলাম, ছবিটি মাথায় চাপ তৈরি করে। যখন একটি ফ্রেম দীর্ঘক্ষণ ধরে স্থির থাকে, তখন মাথা বলতে থাকে, তারপর, তারপর কি হতে যাচ্ছে, দৃশ্য সরছে না কেন? ব্যতিক্রমী ছবিটিকে অনেকে পছন্দ না করলেও, প্রশ্নোত্তর পর্ব পর্যন্ত অনেকেই কিন্তু বসেছিলেন, আলোচনা শুনেছেন, মাঝপথে উঠে চলে যাননি।
আমিও পুরো আলোচনা শেষ করে যখন উঠলাম, তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারো। বাইরে বেরিয়ে দেখি বরফ অনেকখানি গলে সরে গেছে। রাস্তাঘাট দেখা যাচ্ছে। তবে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের প্রকোপ বেড়েছে। এর ভেতরেই পাব ও নাইটক্লাবের সামনে জড়ো হয়ে ‘কঠিন পানীয়’ ও ধূমপান করছে তরুণ-তরুণী। তাদের রাত মনে হয় কেবল শুরু হলো। বাইরে থেকে ক্লাবের কাচের ওপারে দেখা যাচ্ছে তরুণদের। জোড়ে দ্রুত লয়ের কোনো গান বাজছে। কেউ বসে আড্ডা মারছে। কেউ বা খেলছে পুল। আমি জটলা ছাড়িয়ে, দুলে দুলে স্টেশনের দিকে। চড়ব রাতের ট্রেনে।