বাংলাদেশের সবচেয়ে যোগ্য সুরকার ও সংগীত শিক্ষকের মৃত্যুর তিন বছর পরে তেমন আওয়াজ নেই দেখে ভালো লাগলো। জানা যায়, পারিবারিক উদ্যোগে একটা ওয়েবসাইট হয়েছে আজাদ রহমানকে নিয়ে। তবে এটা তো সত্যি, আজাদ রহমানের সুর বুঝতে যে সফিস্টেকেশন লাগে, তা আমাদের নাই। আর বাংলাদেশের সব মিউজিক ডিরেক্টর ঠেকে ঠেকে শেখা বা করতে করতে শেখা। তিনি একমাত্র লোক, যিনি কাজটার পারফেকশন বুঝতেন। ভাবুন একজন ক্লাসিকালের ওস্তাদ সিনেমায় সুর দিতেন, কী ধরনের সিনেমার গান তখন হতো। কবীর সুমন বাংলা খেয়াল নিয়ে কাজ করছেন। তিনি অব্ধি আজাদ রহমানের অবদানকে মূল্য দেন। মূল্য নেই কেবল এ বাংলাদেশে।
তবুও তিনি নিজের কাজ করে গেছেন। বয়সকালে আমাদের মুসলমানদের ভর করে এপোলজিস্ট মন, যে গান বাজনা ভালো না। তিনি ভাবতেন এটাই আমার কাজ, এটাই আমার সাধনা, এটাই ইবাদত।
আজাদ রহমানের জন্ম বর্ধমানে। ছোট বেলা থেকেই তিনি সংগীতে আগ্রহী। তার বাবা যাত্রা ও লেটো গানে সুর দিতেন, বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, গাইতেন। আজাদও ঘুঙুর বেঁধে নাচতেন। তার বাবা চাইতেন না তিনি এ জগতে আসেন। তাদের পারিবারিক পীর তার বাবাকে রাজী করান। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক কিছু শিখেছেন। ক্লাসিকাল, খেয়াল, ঠুমরী, গজল কীর্তন, নজরুল সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত, অতুল প্রসাদ, পিয়ানো, হারমোনিয়াম বাজানো সব কিছুই পারতেন। রবীন্দ্র ভারতী থেকে মাস্টার্স পাশ করেছেন। কলকাতার এক ছবি ‘মিস প্রিয়ংবদা’তে সুরকার ছিলেন। সেই সূত্রেই মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা মুখোপাধ্যায়, আরতী মুখার্জীদের সঙ্গে কাজ করেছেন। কলকাতার এক সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা দলেও ছিলেন। বোম্বেতেও চেষ্টা করেছিলেন ভাগ্যের—দিলীপ কুমারের সঙ্গে তার আলাপও হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে এসে ওনাকে আবার শুরু করতে হলো নতুনভাবে। রেডিওতে অডিশন দিলেন, বাংলা ক্লাসিকাল নিয়ে কাজ করতেন। ছায়ানটে শেখাতেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এ শহরের অন্যতম সংগীত শিক্ষকে পরিণত হন। কিন্তু আজাদ রহমান কখনোই এত বিখ্যাত হতেন না যদি না তিনি সিনেমায় সংগীত পরিচালক না হতেন। বাবুল চৌধুরীর ‘আগন্তুক’ ছবি দিয়ে শুরু। কিন্তু তাঁকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে নায়ক সোহেল রানাখ্যাত মাসুদ পারভেজের সঙ্গে কাজ। বিখ্যাত যত চলচ্চিত্র পরিচালক, সবার সঙ্গেই তার অনেক কাজ আছে। ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত’, ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই’, ‘মনেরও রঙে রাঙাব’, ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি’সহ বহু গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। কোনোটির সুরকার তিনি, কোনোটির সংগীত পরিচালক।
তার একটা গল্প আমার প্রিয়, সংগীত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। কী কারণে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েন। চাকরি চলে যায়। সাত বছর কেস লড়ে তিনি জিতে পাওনা সব বেতন বোনাস নিয়ে ফের শিল্পকলায় জয়েন করেন। অনেকেই তাকে পাকিস্তানপন্থী বলেন। আমি এর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাইনি। তাকে উল্টো পাকিস্তানি মিলিটারি নিয়ে গিয়েছিল। তিনি হিন্দি ছাড়া আর কোনো ভাষা জানেন না ও তিনি মোহাজের এসব বলে টলে মুক্তি পান। বেতারের তখনকার ডিরেক্টরও তার পক্ষে ছিলেন। তাই সবাই ধরে নিয়েছে তিনি স্বাধীনতা বিরোধী। করারি ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে আজাদ রহমান নয়ীম গহরের কথায় ও নিজের সুরে রেকর্ড করিয়েছেন, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’। তাকে ‘কোলাবরেটর’ ভাবতে আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। জন্ম আমার ধন্য হলো—এই গানে সে সময় কণ্ঠ দেন নজরুলসংগীতের প্রখ্যাত শিল্পী ফিরোজা বেগম ও সাবিনা ইয়াসমীন। তাদের সঙ্গে নেপথ্যে সমবেত কণ্ঠ দেন জিনাত রেহানা, নাসির হায়দার, আহমেদুল্লাহ সিদ্দিকী, আসাদুল হক ও লায়লা মোজাম্মেল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর এই গান সাবিনা ইয়াসমীনের একক কণ্ঠে আবার ধারণ করা হয়। বশির আহমেদ, খুরশীদ আলম, আবদুল হাদী, সেলিনা আজাদ এরকম বিখ্যাত সব শিল্পীকে চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে জনপ্রিয় করেছেন তিনি। রুনা লায়লা প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন তার সুরে গান গেয়ে। তিনি একমাত্র সুরকার, সংগীত পরিচালক ও কন্ঠশিল্পী এ তিন ক্ষেত্রেই তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছেন। জীবনের শেষ সময়গুলোতে তিনি বিটিভিতে গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। এ দেশে আজাদ রহমানের ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যাও কম নয়। প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এই সুর সাধককে।