• ঢাকা
  • রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩০, ২৪ শা'বান ১৪৪৬
বার্লিনে বায়োস্কোপ ১২

গল্পবিক্রেতার চেয়ে গল্পবলিয়েকে বেশি জরুরি


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫, ০৩:০৯ পিএম
গল্পবিক্রেতার চেয়ে গল্পবলিয়েকে বেশি জরুরি
বার্লিন থেকে বিধান রিবেরুর জার্নাল

বার্লিনে ফুটপাতের উপর সাইকেলের জন্য আলাদা পথ করে দেয়া রয়েছে। আর সেই পথ দিয়ে প্রচুর মানুষ সাইকেল চালায়। রাস্তাঘাটে পয়সা দিয়ে সাইকেল ভাড়া নেয়া যায়। এমনকি আমি যে এপার্টমেন্টে উঠেছি, সেটার সামনেই গোটা পাঁচেক সাইকেল রাখা আছে। আমাকে সেগুলোর চাবিও দেয়া হয়েছে, ইচ্ছে করলে সাইকেল নিয়ে যেন বেরুতে পারি। কিন্তু কথা হলো এই কনকনে ঠাণ্ডার ভেতর সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরির কোনো মানেই হয় না। তবে জার্মানরা দিব্বি সেটা করছে। বেশি দূরে যেতে হলে ট্রেনের ভেতরে সাইকেল নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, মেট্রোস্টেশনে ঢোকার পথে ওঠানামার জন্য ব্যবহার করছে লিফট। যাতায়াতের জন্য সাইকেল খুবই চমৎকার বাহন। পরিবেশ দূষণ করে না। ঢাকা তো দূষিত শহরের তালিকায় গত কয়েক বছর ধরেই চ্যাম্পিয়নের শিরোপা ধরে রেখেছে।  


বার্লিনের আরো একটি বৈশিষ্ট্য আমার ভালো লেগেছে। সেটি হলো এখানকার পাড়ামহল্লায় মোড়ে মোড়ে ক্যাফে আর বইয়ের দোকান। আমার বাসার পাঁচ মিনিট দূরত্বের ভেতরেই দুটি বইয়ের দোকান। একটা রাস্তার এপারে, অন্যটি ওপারে। মানে আপনি বইটই কিনে ক্যাফেতে বসে আরামসে সকালটা কাটাতে পারবেন। যদি অন্য কোনো কাজ না থাকে। আমি সকাল-সকাল যেদিন বের হই সেদিন দেখি বুড়োবুড়িরা ক্যাফেতে বসে কেউ বইপত্র পড়ছে, কিংবা কথা বলছে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে।


উৎসবের নবম দিনে আমার ছবি দেখার কথা রয়েছে দুটি। তবে তার আগে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে দুপুরের খাবার খেলাম অনুবাদক ও লেখক নাজমুন নেসা পিয়ারির সঙ্গে। উনি দুপুরের নেমন্তন্ন করেছিলেন আগেরদিন। আমি রক্ষা করেছি। পিয়ারি আপা চমৎকার মানুষ। ফেস্টিভাল ভেন্যুর কাছেই তার বাসা। বার্লিনালের সময় বাংলাদেশ ও কলকাতার জন্য তিনি প্রতিবারই লেখা পাঠান। এবারও পাঠাচ্ছেন। দুপুরের খাবারে একটি চিকেন ডিশের আগে, জার্মানদের খুব প্রিয় মিষ্টিকুমড়ার স্যুপ খাওয়ালেন পিয়ারি আপা। ক্রিম ও বাদাম দেয়া স্যুপটি বেশ সুস্বাদু লেগেছে। তো আমরা দুপুরের খাবার খেতে আলাপ করলাম দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, জার্মানির রাজনীতি ও বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের ভবিষ্যৎ নিয়ে।


পিয়ারি আপা এসময় খুব মজার একটি তথ্য দিলেন। এটা আমার জানা ছিল না। কবি শহীদ কাদরীর যখন প্রথম বইটা বেরুল ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, তখন সেটার প্রচ্ছদ করেছিলেন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। প্রচ্ছদে নারী মুখমণ্ডল থাকায় কবির সেটা পছন্দ হয়নি। তখন তিনি দ্বারস্থ হন স্ত্রী পিয়ারির কাছে, যেহেতু পিয়ারি আপা ছবি আঁকতে জানতেন, তাই তিনি তাকেই বললেন, প্রচ্ছদ এঁকে দিতে। প্রচ্ছদ আঁকা হলো এবং সেটা বইয়ের উপরে গেল। প্রকাশনা উৎসবে নাকি কাইয়ুম চৌধুরী মজা করে পিয়ারি আপাকে বলেছিলেন, তুমি কি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছো? এমন আরো অনেক ছোট ছোট গল্প করলাম পিয়ারি আপার সাথে। কিন্তু দুপুর দুটায় যে আরেকটা মিটিং রয়েছে! অর্বুদ ধন্যবাদ জানিয়ে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় নিতে হলো। কারণ চলচ্চিত্র পরিচালক মাকসুদ হোসেন আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।


হায়াত হোটেল থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গেলাম শপিং মলের দিকে। সেখানকার  দোতলায় মাকসুদ বসেছিলেন। তরুণ পরিচালক। ‘সাবা’ তার প্রথম ছবি। এই ডেব্যু ফিল্মটি নিয়ে তিনি দুনিয়ার বিভিন্ন ফেস্টিভালে ঘুরছেন। আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছেন। যদিও আমি ছবিটি দেখিনি, তবে অনেকেই প্রশংসা করছেন ছবিটির, নিশ্চয় ভালো বানিয়েছেন তিনি। আমার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা এখন কেমন, সে বিষয়ে। বললাম, আগের চেয়ে ভালো, তবে এখনো বহুদূর যেতে হবে। আমাদের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো সক্রিয় ও কার্যকরী করতে হবে। পাশাপাশি বাংলা ভাষার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। নিজের ভাষায় ভালো সাহিত্য তৈরি না হলে, ভালো চলচ্চিত্রও নির্মাণ হবে না। অতর ফিল্মমেকারও তৈরি হবে না। মাকসুদ আমার সাথে একমত হলেন। 

 

উনি যোগ করলেন, নির্মাতাদের নিজেদের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। তবেই বড় বড় উৎসবগুলো এগিয়ে আসবে। বড় বড় প্রযোজকরা আগ্রহী হবে। জানালেন, তিনি নিজ উদ্যোগেই দুনিয়ার বড় বড় উৎসবে ছবি জমা দিচ্ছেন এবং সেগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে। তবে তিনি চান, আমিও চাই, বার্লিনে বাংলাদেশের ছবি অফিশিয়ালি সিলেক্টেড হোক। হবে নিশ্চয় সামনে। তারজন্য আমাদের হয়ে উঠতে হবে ভালো গল্পবলিয়ে, গল্পবিক্রেতা হলে চলবে না। ভিম ভেন্ডার্স যেমনটা বললেন, কদিন আগে, এখন স্টোরিসেলার বেশি, স্টোরিটেলার কম।


তরুণ নির্মাতা মাকসুদের উদ্দীপনা ও কাজ করে যাওয়ার স্পৃহা দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগল। নিশ্চয় তিনি আমাদের দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবেন একদিন। শুভ কামনা জানিয়ে, এবারও জোর করেই উঠতে হলো, কারণ সাড়ে তিনটায় বার্লিনালে পালাস্টে দেখতে যাব ব্রিটিশ ছবি, রেবেকা লেনকুইচ পরিচালিত ‘হট মিল্ক’ (২০২৫)। ছবিটি কম্পিটিশন সেকশনে রয়েছে। গ্রীষ্মের সময় স্পেনে, সাগরঘেষা নগর আলমেরিয়াতে নিজের অজানা রোগের চিকিৎসা করাতে ষাটোর্ধ্ব রোজ যায় ডক্টর গোমেজের কাছে। সাথে তরুণী মেয়ে সোফিয়া। 

 

ছবি যত গড়ায় ততই দর্শক বুঝতে থাকে, শুধু মা রোজের নয়, মানসিক সমস্যা রয়েছে সোফিয়ারও। মায়ের আরোগ্য লাভই মূল কারণ স্পেনে আসার, কিন্তু সেই সুবাদে সোফিয়ার পরিচয় ঘটে ইনগ্রিড নামের এক রহস্যময়ী পর্যটক নারীর সঙ্গে। তার সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সোফিয়ার। কিন্তু ইনগ্রিড অন্য পুরুষদের সাথেও অবাধে মেলামেশা করে। সোফিয়ার সেটি পছন্দ হয় না। একদিকে প্রেমিকা ইনগ্রিড, অন্যদিকে মায়ের আরোগ্য লাভের চেষ্টা, মাঝে দূরে বাবার সাথে দেখা করতে যাওয়া, সব মিলিয়ে সোফিয়া এক মানসিক টানাপোড়েনের ভেতর পড়ে যায়। সে মাকে সুস্থ করে নিজে মুক্ত হতে চায়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় সোফিয়া তার মাকে হুইলচেয়ার থেকে নামিয়ে হাঁটাবার জন্য মাঝরাস্তায় এনে বসিয়ে রাখে। ওদিকে বিশাল লরি আসছে ভেপু বাজাতে বাজাতে। তারপর অন্ধকার। এখানেই শেষ হয় ছবিটি।


সব মিলিয়ে মধ্যম মানের ছবি মনে হলো। ভালো নয়, আবার মন্দও নয় ধরনের ছবি। একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে এবার যেতে থাকলাম ব্লুম্যাক্স থিয়েটারের দিকে। ওখানটায় দেখানো হবে অস্ট্রেলিয়ার ছবি ‘দ্য ন্যারো রোড টু ডিপ নর্থ’ (২০২৫)। পরিচালকের নাম জাস্টিন কারজেল। ছবি শুরু মিনিট দশেক আগে হলে ঢুকলাম। হলে ঢুকেই দেখি নিজের মোবাইলে কি যেন লিখছে আমার পরিচিত ফিল্ম ক্রিটিক ও স্পেনের পরিচিত সাংবাদিক মারিওনা বরুল। ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ২০২৩ সালে টরন্টোতে। আমাকে দেখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলল, আরে বিধান তুমি। আমি জানতাম তুমি এসেছো। এরপর সাধারণ কুশলাদি বিনিময় করে বিদায় নিলাম। ও জানালো সিনেমা শেষ করেই সে বেরিয়ে যাবে, পরেরদিনই ফ্লাইট।


আমি পেছনের সারিতে গিয়ে বসলাম। বার্লিনাল স্পেশাল গালা বিভাগে প্রদর্শিত এই ছবিটি একজন অস্ট্রেলিয় চিকিৎসক ডোরিগো ইভান্সের স্মৃতিনির্ভর কাহিনি। মূলত দুটি স্মৃতির ভেতরেই সাঁতার কাটে বয়স্ক ইভান্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী মিত্রবাহিনীর সেনাদের দিয়ে থাই-বার্মা রেলপথ বানানোর স্মৃতি তাকে তাড়িত করে। বিভীষিকাময় সেই দিনগুলোতে তিনি মেডিকেল অফিসার হিসেবে বন্দীদের চিকিৎসা করতেন। ঘন বন কেটে, পাথর সরিয়ে রেলপথ বানাতে গিয়ে অমানবিক কষ্ট করেছে বন্দীরা। আর জাপানি সেনারা ছিল নৃশংস। তারা সামুরাই চালিয়ে দুর্বল নিরস্ত্র বন্দীর কল্লা ফেলে দিতেও কসুর করত না। তো ডাক্তার ইভান্সের এই দুঃসহ স্মৃতির পাশাপাশি ছিল নিষিদ্ধ প্রেমের স্মৃতি। তারই সমবয়সী এক চাচি, এমির সাথে প্রণয়ের স্মৃতি। তো বয়সকালে ইভান্সকে ঘুরেফিরে এমির প্রেম খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায় বিভিন্ন নারীর ভেতর। আর যুদ্ধদিনের স্মৃতি মনে পড়লে সে বিষণ্ণ বোধ করতো। 


ছবিটি দেখে আমার মনে হয়েছে ভিন্ন একটা কথা। আমার কেবলই মনে হয়েছে, দুই নম্বর বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনবাহিনি যে কতটা খারাপ ছিল এবং এ কারণে জাপানের উপর পারমানবিক বোমা ফেলাটা যে কতটা ঠিক ছিল, এই সিনেমা সেটারই সাফাই গেয়েছে। বা দু-দুটো পারমানবিক বোমা ফেলার বৈধতা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে এই ছবিতে। নয় তো প্রেম ও যুদ্ধকালে রেলপথ তৈরির স্মৃতি নিয়ে বানানো ছবিতে জাপানি সেনাদের এতটা নিষ্ঠুর দেখানোর কি মানে!


ছবিটা দেখে বেরিয়ে এসে দেখি মোবাইল ফোনে পর্যাপ্ত চার্জ নেই। মলে গিয়ে বসে বসে ফোনে চার্জ দিচ্ছি আর ভাবছি তন্বী এত করে ওর বাসায় খেতে যেতে বলছে! না গেলে নির্ঘাত মন খারাপ করবে। কিভাবে যাব সেটা ভাবছি। ও যদিও ঠিকানা দিয়ে লিখে দিয়েছে। বেশি দূরে নয়, এক স্টেশন পরই, ইয়র্কস্ট্রসের স্টেশনে নেমে মিনিট দশেক হাঁটতে হয়। বসে বসে এসব ভাবছি, হঠাৎ দেখি আমার ইতালিয় কো-জুরি সারা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ উত্তেজিত হয়ে সে তার মোবাইল থেকে বের করে বিবিসির একটা খবর দেখাল, বার্লিনে স্পেনিশ এক টুরিস্টকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। অবস্থা মোটামুটি খারাপ। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং অপরাধী সন্দেহে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সারা ভীষণ পয় পেয়েছে। সে আমাকে বলছে, সাবধানে থাকতে। চোখকান যেন খোলা রাখি। সে দ্রুত বাসায় ফিরছে। ওর চোখেমুখে আতঙ্ক। আমি ওকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম। আর মনে মনে বললাম, বাংলাদেশে গেলে তো তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে। ঢাকাতে যে হারে কোপাকুপি হচ্ছে, সেটা তো আর বিশ্বের গণমাধ্যম প্রচার করছে না। 


যাইহোক, সারা চলে গেলে আমি ধীর পায়ে তন্বীর বাসা খুঁজেটুজে বের করলাম। গিয়ে দেখি বার্লিনের বাইরে থেকে ওর স্কুলবন্ধু মুনিমা এসেছে। মুনিমাও জার্মানিতে আছে প্রায় আট-নয় বছর ধরে। বাঙালি ঢংয়ে রান্না করা ফুলকপির সাথে চিংড়ি, আর মুরগির তরকারি দিয়ে পোলাও খাওয়া হলো। খেতে খেতে ওরা জানালো জার্মানিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন, সেকারণেই হয় তো হামলার ঘটনা বেড়ে গেছে। কারণ উৎসব শুরুর কদিনের মাথাতেই মিউনিখে এক আফগান লোক ডজনখানেক লোকের উপর দিয়ে গাড়ি উঠিয়ে দিয়েছে। আমিও বললাম, নির্বাচনের সাথে যোগ থাকলে অবাক হবো না। ক্ষমতা পাওয়ার জন্য দেশে দেশে কত কি যে হয়, আমরা তা জানি না। দেশের ভেতরেই তো কত কিছু হয়ে গেছে, আমরা কি তার খবর রেখেছি, না পেয়েছি! দুনিয়ায় ক্ষমতাটাই যেন সব। আর সব তুচ্ছ।

Link copied!