স্মিতা পাতিল স্মৃতি পুরষ্কার নেওয়ার সময় নায়িকা রেখা বলেছিলেন, তার জীবনে তিনি স্মিতা পাতিলের মত কনফিডেন্ট মানুষ দেখেননি। যার অভিনয় থেকে শুরু করে, কথা বলা, হাসা, দাঁড়ানো সব কিছুর ভেতরই একটা আত্মবিশ্বাসে ঠাসা মানুষ ছিল। বাস্তব জীবনে আমরা কেউই ওরকম আত্মবিশ্বাসী নই। আত্মবিশ্বাস ও সাহসের যদি কেউ থাকে বলিউডে সেটা রেখাই। তিনি একজন অন্যরকম মানুষ।
এই যে সুশান্তের আত্মহত্যার জন্য দায় করা হলো রিয়াকে, বলিউডে এই ট্রেন্ড নতুন না। রেখার স্বামী মুকেশ আগরওয়ালের আত্মহত্যায় মৃত্যুর জন্য রেখাকে দায়ী করা হতো। রেখা কেন সিঁদুর দেয় তা নিয়ে হাসাহাসি হতো প্রকাশ্যে। শাহরুখ খানকে যেমন দায়ী করা হয়েছিল তার ছেলের অপরাধে। তাই বলিউডে কিছুই না নতুন। সব কিছুই নানান কিছুর ভেতরে ফিরে ফিরে আসা।
ভারতের নায়ক নায়িকারা তো সমাজের এলিট শ্রেণির লোক। তাদের মতো মানুষদের বিপন্নতার কথা ভেবে নিজের বিপর্যস্ততা ভুলি। যেমন ধরেন, সবার প্রিয় নায়িকা রেখার কথা। তো রেখা অভিনেতা বিনোদ মেহরাকে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। বিনোদ মেহরাও কামেল লোক, ৪৫ বছরের জীবনে ছবি করেছেন ১০০টি। বিয়ে করেছেন চারখানা। ওনার এক স্ত্রী অভিনেত্রী বিন্দিয়া, পরে জেপি দত্তের সহধর্মিণী হন। রেখার সঙ্গে বিনোদ মেহরার বিয়ে মাস চারেক টিকে ছিল। কিন্তু এই বিয়ে রেখার জীবনে অন্যতম কষ্টের ঘটনার জন্ম নেয়। বিয়ের কিছুদিন পর বিনোদ মেহরা রেখাকে নিয়ে তার বাসায় এসেছিলেন। বিনোদ মেহরার মা এত ক্ষুব্ধ ছিলেন যে তাকে চটি পেটা করতে উদ্ধত হন, বাড়িতেই ঢুকতে দেননি। বিনোদ মেহরা রেখাকে পরে তার ফ্ল্যাটে রেখে আসেন। রেখার বারবার মনে হচ্ছিলো তিনি যেন তার মায়ের জীবনে ফিরেছেন। তার মাকেও সুপারস্টার জেমিনি গনেশান স্বীকৃতি দেননি, অভিনেত্রী সাবিত্রীর সঙ্গে সুখের সংসার করেছেন দশকের পর দশক।
পাহাড়ী স্যানাল উর্দু ছবিও করতেন। তার করা ছবি, ১৯৬০ সালের সাহেলিতে হেভি কাস্টিং। শামীম আরা, সৈয়দ ইশরাত, নাইয়ার সুলতানা মিলে ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। রেখার জন্মদিনে এ ছবির নাম কেন আনলাম। এখন রেখার অন্যতম জনপ্রিয় গান, হাম ভুল গায়ে রে হার বাত মূলত এই ছবির উর্দু গানের রিমেক ভার্শন। এটা আমি আগে জানতাম না।
রেখা রুপালি পর্দায় অভিনয় শুরু করেন ১৯৬৬ সালে, ‘রাঙ্গোলা রত্নাম’ নামে একটি তেলেগু ছবি দিয়ে। শুরুটা করেছিলেন শিশু শিল্পী হিসেবে। তবে নায়িকা হিসেবে ১৯৭০ সালে ‘শাওন ভাদো’ নামে একটি ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বলিউডে ক্যারিয়ার শুরু করেন। শুরু থেকেই সাফল্য পেয়েছিলেন রেখা। তবে তার স্বপ্ন ছিল একদিন মুমতাজের মতো খ্যাতি লাভ করবেন। শ্যামবর্ণের মেয়েটির জন্য যদিও বিষয়টি তেমন সহজ ছিল না। সেদিন তার পাশে এসে দাঁড়ান তারই এক সহশিল্পী, পরে যিনি সহশিল্পী থেকে প্রেমিক হয়ে ওঠেন। তার পরামর্শে মেকওভার করে নিজেকে আমূল বদলে ফেলেন। বলিউডও সেই রেখাকে স্বীকৃতি দেয় সেক্সসিম্বল নায়িকা হিসেবে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
ছোটবেলায় তার প্রতিটি দিন কেটেছে অনিশ্চয়তায়। কেননা তার বাবা তাকে স্বীকার করেনি। বাবা-মা দুজনেই দক্ষিণের নামী অভিনয় শিল্পী ছিলেন। তাদের সন্তান হিসেবে মসৃণ জীবনই হয়তো পাওনা ছিল তার। নামী অভিনেতা বাবা তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। কেননা তার বাবা ও মায়ের প্রথাগত বিয়েটাই হয়নি। আর তাই পিতৃত্ব স্বীকারে নারাজ ছিলেন ভানুরেখার বাবা। একরকম পরিবার চালানোর দায়েই কিশোরী বেলায় শিল্পী হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখতে হয়েছিল তাকে। সংগ্রাম, পরিশ্রম আর মেধার কারিকুরি দেখিয়ে শীর্ষে পৌঁছান ভানুরেখা গণেশন।
আজীবন প্রান্তিকতা থেকে মূলস্রোতের ফেরার সংগ্রাম করে চলেছেন। তার ছেলেবেলাটা যেমন ছিল অমসৃণ, তেমনি জীবন তাকে জড়িয়ে নিয়েছে নানান দুর্ভাগ্যে। তবে সৌভাগ্যের গল্পও আছে। রেখাকে নিয়ে ‘উমরাও জান’ ছবিতে মোজাফফর আলী কনফিডেন্ট ছিল না। একটা ছবির জন্য রেখা উর্দু শিখেছেন, শের শাইরি কিভাবে রিসাইট করে তা শিখেছেন, নাচ শিখেছেন নতুন করে, তারপর এ ছবি করে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছবিতে ভালো অভিনয় করার বড় কারণ অমিতাভের সঙ্গে প্রেম ও বিচ্ছেদের যে ঘটনা, তার সঙ্গে সিনেমার প্লটের আশ্চর্য মিল। মনে হবে উমরাও জান রেখার জীবন নিয়েই বানানো।
বিবিসিতে রেখা এক সাক্ষাৎকারে মেহেদী হাসানের গান গেয়েছিলেন, এত মিষ্টি। রেখা প্যারালাল সিনেমাতেও সাবলীল। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে, বাসু চ্যাটার্জি ‘আস্থা’ সিনেমাটা যেমন। এক বিবাহিত মেয়ে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে টাকা আয়ের পথ ধরে। নব্বইয়ের দশককে মহান বানান সবাই। নব্বই দশক ছিল মোরাল পুলিশিংয়ের সেরা সময়। সবাই রেখার সমালোচনা করছেন এত সুন্দর ছবি হওয়ার পরেও। তাই রেখা এমনি। তিনি অক্ষয় কুমারের সঙ্গে তার জীবনের অন্যতম বোগাস সিনেমা, ‘খিলাড়িও কা খিলাড়ি` করেন, আবার গুলজার বানানো ‘ইজাজত’ করেন। তিনি আবার মীরা নায়ারের ‘কামাসুত্রা’তেও থাকেন। কোনো কিছুতেই তাকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। তিনি রেখা, তিনি অদ্বিতীয়া। তিনি অনন্য। জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।