বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাত মিলনায়তনের নাম বদলে যাচ্ছে। এর মধ্যে থাকছে জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তনও। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নাট্যশালায় এক অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ নামকরণের বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি জানান, শিল্পকলা একাডেমির তিনটি মিলনায়তনের নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পরিবর্তিত নামও চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এদিন সন্ধ্যায় একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় স্ট্যান্ডআপ কমেডি ‘জোকের রাজনীতি’। যেখানে কৌতুক পরিবেশন করেন আখলাক সিদ্দিকী, শাওন মজুমদার, সৈয়দ রিদওয়ান হাসান, মেহেদী হাসান তরু ও সামি দোহা। এই অনুষ্ঠানেই হাজির হয়ে শিল্পকলার মহাপরিচালক পরিবর্তনের বিষয়টি জানান।
তার ঘোষণা মতে, একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা ভবনের এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলের নামকরণ করা হয়েছে সেলিম আল দীন নাট্যালয়, স্টুডিও থিয়েটার হলের নামকরণ করা হয়েছে চন্দ্রাবতী নাট্যালয় এবং প্রধান মিলনায়তনকে করা হচ্ছে কবি আলাওল নাট্যালয়।
বিষয়টি নিয়ে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, ‘নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবনা শিল্পকলা পরিষদের বৈঠকে পাস হয়েছে। এখন শুধু উপদেষ্টার স্বাক্ষর বাকি। শিগগিরই সেটা সম্পন্ন হয়ে যাবে।
পরিবর্তনের ভাবনা কিভাবে এলো? নতুন নামও বা বাছাই করা হয়েছে কোন প্রক্রিয়ায়? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নাট্যশালা একটি ভবনের নাম, অডিটরিয়ামের নাম তো নাট্যশালা হতে পারে না। এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারের ভাবনাটা শুরুতে আমারই ছিল, কিন্তু এটা তো মিলনায়তনের নাম হতে পারে না। আমাদের মনে হয়েছে, নাট্যাঙ্গনে যাঁদের অবদান আছে, তাঁদের নামেই নামকরণ করা উচিত। সেই ভাবনা থেকে নাম আহবান করা হয় এবং ভোটাভুটির মাধ্যমে নতুন নাম বেছে নেওয়া হয়েছে।’
শোনা যাচ্ছে, শুধু এই তিনটি নয়, একাডেমির চারুকলা ভবন এবং সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্যকলা ভবনের আরো চারটি মিলনায়তনের নামও বদল করা হচ্ছে।
এর মধ্যে সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্যকলা ভবনের একটি মিলনায়তন এবং নির্মীয়মাণ আরেকটি মিলনায়তনের নামকরণ করা হচ্ছে সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং মরমী সাধক শাহ আবদুল করিমের নামে।
চারুকলা ভবনের মিলনায়তন এবং নির্মীয়মাণ আরেকটি মিলনায়তনের নামকরণ করা হচ্ছে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ও ভাস্কর নভেরা আহমেদের নামে। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনই কিছু জানাননি একাডেমির মহাপরিচালক।
শিল্পকলা একাডেমির সাত মিলনায়তনের নাম পরিবর্তন নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন গুনীজন।
এর মধ্যে বরেণ্য অভিনেতা মামুনুর রশীদ বললেন, ‘পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করব | এটা খুবই অন্যায় হচ্ছে। জাতীয় নাট্যশালা সব দেশে থাকে। হঠাৎ নাম পরিবর্তনের কী প্রয়োজন হলো তাঁদের, বুঝতে পারলাম না। খুব অপ্রয়োজনীয় একটি কাজ করছেন। এটার কোনো মানেই হয় না। ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে, আমরা খুশিও হয়েছিলাম। কিন্তু কেউ কি তাঁদের নামে রাস্তাগুলো চেনে? এসব সিদ্ধান্ত একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এই লোকগুলো কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছে না, এ জন্য এসব নাম বদল করছে। এই নামগুলো থাকবেও না।
অন্তর্বর্তী সরকারের পর নতুন সরকার আসবে, তখন এই নামগুলো কেউ রাখবেও না। তখন কী হবে? আমাদের তো মানুষই মনে করে না। আমরা যাতে অভিনয় না করি, তার সব ব্যবস্থা তিনি বসে বসে করছেন। এই নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করব। সেলিম আল দীন কি খুব অতীত হয়ে গেছেন? মুনীর চৌধুরীর নামে নয় কেন? এই নাম পরিবর্তনের অধিকার তাঁকে কে দিয়েছে? হু গেভ হিম অথরিটি? একটা দেশে সংসদ আসবে ভবিষ্যতে। সেখানে আলোচনা হবে। জাতি যদি চায়, তখন পরিবর্তন হবে। আমি উপদেষ্টাদের প্রতি আহবান জানাই, তাঁরা বিষয়টি বিবেচনা করবেন এবং এই পরিবর্তন হতে দেবেন না। এটা খুব অগণতান্ত্রিক একটি সিদ্ধান্ত। নাট্যকর্মীরাও চাচ্ছেন না।
অভিনেতা ও নাট্যজন তারিক আনাম খান বলেছেন, ‘ আমি জানি না। কী নাম হচ্ছে, তা-ও জানি না। খুব আশ্চর্য লাগছে। জাতীয় নাট্যশালা নাম তো ভালো, অনেক দেশেই আছে, স্টুডিও থিয়েটার নামও সুন্দর। এটা ঠিক যে, যাঁরা নাট্যাঙ্গনে অবদান রেখেছেন, তাঁদের স্মরণ রাখার জন্য নামকরণ করা যেতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই পরিবর্তনের কোনো দরকার ছিল না। অবশ্যই সেলিম আল দীন শ্রদ্ধার মানুষ, তার অবদান বিশাল। পরিবর্তন নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনাও হয়নি। এগুলো আসলে দ্বিমত তৈরি করে। অমুক এই পক্ষে, তমুখ ওই পক্ষে। এর ফলে যাঁরা শ্রদ্ধেয় মানুষ, তারাই পরে বিতর্কে পড়ে যান। এ কারণে এটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
বরেণ্য নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ বলেছেন, ‘নাম পরিবর্তন নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেয়ে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকাকে আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি। আমরা নাম পরিবর্তনের পেছনে যে মেধা, অর্থ ও সময় ব্যয় করি, সেটা যদি সংস্কৃতির কাজে ব্যয় করি—সেটাই উত্তম হবে। এটুকুই আমার বক্তব্য।