• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩০, ১৪ শা'বান ১৪৪৬
বার্লিনে বায়োস্কোপ ২

লাল ভল্লুক ও লৌহ-যবনিকা


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫, ১০:০১ পিএম
লাল ভল্লুক ও লৌহ-যবনিকা
বার্লিন থেকে বিধান রিবেরুর জার্নাল

বার্লিনের দেয়ালে দেয়ালে শুধু নয়, কফিশপ থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, উৎসবের আশপাশের রাস্তাঘাট, সর্বত্র ৭৫তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রচার-প্রচারণা। কোথাও বিশাল পোস্টার তো কোথাও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর সময়সূচির পুস্তিকা। বলা যেতে পারে সর্বক্ষেত্রে লাল-ভল্লুকের থাবা। বার্লিনালের প্রতীক হলো রেড বিয়ার।


১১ ফেব্রুয়ারি পুরো দিনটাই ফাঁকা। বার্লিন এসেছি শোনার পর থেকেই তন্বী, আমার ছোট বোন, প্রস্তুত হয়ে আছে আমাকে নিয়ে শহর ঘুরিয়ে দেখাবে। তন্বী, আসলে আমার ছোটবেলার বন্ধু-ভ্রাতা তাহসিনের ছোট বোন। প্রায় নয় বছর ধরেই বার্লিনে থাকছে। এখানকার নাড়ি-নক্ষত্র ওর চেনা। তন্বী বলে আমি ওর বড়ভাই এক্সটেনশন। তো দুপুর নাগাদ আমার ঠিকানায় এলে আমরা বেরিয়ে পড়ি প্রথম উৎসব প্রাঙ্গনের দিকে। কারণ প্রথম কাজ জুরি ব্যাজ সংগ্রহ করা। 


আমার বাসা যেখানে, নাউম্যানস্ট্রস থেকে তিন মিনিটের হাঁটা দূরত্বেই জুলিয়াস-লেবার-ব্রুক স্টেশন। সেখান থেকে এস-ওয়ান ট্রেনে চড়ে দুই স্টশন পেরিয়ে তৃতীয় স্টেশন পটসডোমের প্লাৎজে নেমে পড়ি। এখান থেকে দুই মিনিট হাঁটলে উৎসব-গ্রাম। ফেস্টিভাল অফিসে ঢুকে ব্যাজ সংগ্রহ করে ওদের দেয়া উপহার সামগ্রী ব্যাগের ভেতর গুছিয়ে রাখছি, তখন দেখি তন্বী কাকে দেখে হাত নেড়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে। দেখলাম এক সুন্দরী ভদ্রমহিলাও তন্বীকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন। দেখেই চিনতে পারলাম তিনি নাজমুন নেসা পিয়ারি। লেখক ও সাংবাদিক পিয়ারি আপা সত্তরের দশকে দীর্ঘদিন ডয়চে ভেলেতে কাজ করেছেন। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২০ সালে লাভ করেছেন একুশে পদক। ১৯৭৪ সালে ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতাটি কবি শহীদ কাদরী তাকে উৎসর্গ করেছিলেন।  


পিয়ারি আপা আমাকে চেনেন না। তন্বী পরিচয় করিয়ে দিল। উনি জিজ্ঞেস করলেন কেন এসেছি বার্লিন, বললাম ফিপ্রেসি থেকে ক্রিটিক জুরি হিসেবে এসেছি। পার্সপেক্টিভস সেকশনের ১৪টি ছবি দেখতে হবে। আর কে কে এসেছেন বাংলাদেশ থেকে চানতে চাইলে বললাম, আমি বাদে ‘সাবা’ ছবির পরিচালক মাকসুদ হোসাইনের আসার কথা বার্লিনাল টেলেন্ট প্রোগ্রামে। উনি এসেছেন কি না জানি না। কথায় কথায় পিয়ারি আপা বললেন, চলুন ছবি তুলি, ফেস্টিভালের এম্বিয়েন্স সহ। এরপর আমরা ছবিটবি তুলে বিদায় নিলাম পিয়ারির আপার কাছ থেকে।


থিয়েটারুফের ভবন থেকে বেরিয়ে দেখি, বাইরে কি মিষ্টি রোদ, অথচ রোদের তেজ নেই। এই রোদ যেন সূর্য নয়, কোনো মোলায়েম বাতি থেকে উৎসারিত আলোকঝর্ণা। সামনে থাকা জলাধারে সূর্যকনা পড়ে চকচক করছে। কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডাকে সে পরাজিত করতে পারছে না। তন্বী বলল, চলো ডোনাট খাই। জার্মানদের বেশ পছন্দের খাবার। সামনেই এক ডোনাটের দোকানে ঢুকলাম। বিশাল দোকান। শুধু বাহারি ডোনাট দিয়েই সাজানো। আমি নিলাম আপেলের মিষ্টি চাটনি দেয়া ডোনাট আর তন্বী নিল ক্রিমসহ বাদাম দেয়া ডোনাট। খেতে খেতে ঠিক হলো ও আমাকে বার্লিন দেয়াল দেখাতে নিয়ে যাবে। তখন দুপুরের রোদ এলিয়ে পড়তে শুরু করেছে। দেরি করা ঠিক হবে না। আমরা রওনা দিলাম।


উৎসবের কাছেই দেয়ালের কিছু ভগ্নাংশ রাখা আছে। রয়েছে একটি প্রহরা চৌকি। ওরা জানে কি করে সংরক্ষণ করতে হয়। এই দেয়াল শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করেছে, বিভেদ সৃষ্টি করেছে একই দেশের ভেতর, কিন্তু এই দেয়ালের চিহ্নকে ওরা নিশ্চিহ্ন করে দেয়নি। বরং যে পথ দিয়ে বানানো হয়েছিল দেয়াল, সেখানে ওরা রেখা টেনে দিয়েছে। যেন ইতিহাসকে মানুষ ভুলে না যায়। ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে পারা সভ্য জাতির লক্ষণ। হোক সেই ইতিহাস খারাপ কি ভালো। কারণ ইতিহাসের বয়ান সময়ে-সময়ে পরিবর্তন হতে থাকে, তাতে খোদ ওই ঘটনা পাল্টে যায় না। আমার ঘুরেফিরে কেবল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটার কথাই মনে এলো। বাঙালি জাতি আত্মঘাতী বটে।


আমরা উৎসব এলাকা ছেড়ে বার্লিন ওয়াল মেমোরিয়াল দেখতে ট্রেনে চেপে চলে গেলাম বার্নআওয়ার স্ট্রিটে। সেখানে আরো চমৎকার করে সংরক্ষণ করা হয়েছে দেয়ালের ভগ্নাংশ। পাশেই করা হয়েছে দোতলা একটি ভবন। সেখানে সংরক্ষিত হচ্ছে ইতিহাস। ভেতরে রয়েছে অডিও-ভিজুয়াল সেকশন। আর ইউরোপের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও রয়েছে স্মারক সংগ্রহের দোকান। আমি বার্লিন দেয়ালের ভাঙা দুটো টুকরো কিনলাম চার ইউরো দিয়ে। টুকরো দুটো নেয়া হয়েছে দেয়ালের এমন একটি জায়গা থেকে, যেখানে রঙীন প্রতিবাদী গ্রাফিতি আঁকা হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ও তার অক্ষশক্তি পরাজিত হওয়ার পর জার্মানির পুরোটা চলে যায় মিত্রশক্তির দখলে। এর পরপরই শুরু হয় ভাগাভাগি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স দখল করল জার্মানির পশ্চিম দিক, আর পূর্ব দিক নিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। পুঁজিবাদী আদর্শ ও সাম্যবাদী আদর্শের পার্থক্য স্পষ্ট হলো যখন পূর্ব জার্মানির পেটের ভেতর থাকা বার্লিনকেও পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করা হয়। এ যেন লৌহ-যবনিকা। উপমাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল, ১৯৪৬ সালের এক বক্তৃতায়। এরপর বার্লিনের স্প্রি নদী দিয়ে কম জল গড়ায়নি। 
 

১৯৪৮ সালে পশ্চিম বার্লিনকে অবরুদ্ধ করল রুশ সমর্থিত পূর্ব জার্মানি। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো পশ্চিম বার্লিন থেকে যেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিদায় নেয়, তাই জোসেফ স্ট্যালিনের নির্দেশে দেয়া হয় ব্লকেড। কিন্তু উল্টো দেখা গেল নিজভূমে পরবাসী পশ্চিম বার্লিনবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র টনকে টন খাবার ফেলতে লাগল উড়োজাহাজ থেকে। শিশুদের জন্য চকোলেট। এ ঘটনা শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতার লাইনগুলোকেই মনে করিয়ে দেয়: 
 

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।

 

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের এই উদ্যোগটি পরিচিতি পায় ‘বার্লিন এয়ারলিফট’ নামে। বিমানগুলো দিনের চব্বিশ ঘন্টার ভেতর মিনিটে মিনিটে খাবারদাবার ফেলতে থাকে বৃষ্টির মতো। খাবার পেলেও, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য কষ্টে পড়তে হয় পশ্চিম বার্লিনের লোকেদের। সবাই ভাবছিল এই বুঝি সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমকে দখলে নিতে ঢুকে পড়বে সীমানার ভেতর। যে কোনো মুহুর্তে আবার যুদ্ধ বেধে যাবে। তৃতীয় মহাযুদ্ধ। তবে সেরকমটি আর হয়নি। এক পর্যায়ে ভেস্তে যায় ব্লকেড। ১৯৪৯ সালের ১২ মে, ৩২২ দিনের অবরুদ্ধ অবস্থার অবসান ঘটায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর দশদিন পরই, ২৩ মে ঘোষিত হলো পশ্চিম জার্মানি পরিচিত হবে ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি নামে, এর কয়েক মাস পর পূর্ব জার্মানির পরিচিতি দেয়া হলো জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে। নামকরণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিভাজন রেখা টানা হলো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি ও পুবদিকের সাম্যবাদী শক্তির ভেতর। ঠাণ্ডাযুদ্ধের পারদ তখন চরমে।
 

পশ্চিমে চাকরিবাকরি ছাড়াও ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা। পুবদিক থেকে প্রচুর দক্ষ লোক চলে যাচ্ছিল ওপারে। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ পূর্ব বার্লিন থেকে পালিয়ে চলে যায় পশ্চিম বার্লিনে। এই সংখ্যা পূর্ব বার্লিনের মোট জনসংখ্যার কুড়ি শতাংশ। আতঙ্কিত হওয়ার মতো দশা। কারণ চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী কেউই আর পুবদিকে থাকতে চাইছে না। শুধুমাত্র ১৯৬০ সালেই দুই লাখ লোক পালিয়ে চলে গেছে পশ্চিমে। এটা রোধ করতে না যতটা, তারচেয়ে বেশি পুঁজিবাদ ঠেকাতে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিলেন। তার নির্দেশেই রাতারাতি পশ্চিম বার্লিনের চারদিকে সেনা ও পুলিশ দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া বসিয়ে দেন পূর্ব জার্মানি অর্থাৎ জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের নেতা বাল্টার আলব্রিখট। কাঁটাতার বসানোর কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালের ১৩ আগস্ট রাত দেড়টায়।  


এরপরের ঘটনাগুলো আরো মর্মান্তিক। কারণ শুধু কাঁটাতার বসিয়েই ক্ষান্ত হয়নি পূর্ব জার্মানির নেতারা। তারা এটিকে রূপ দেয় মোটা কংক্রিটের দেয়ালে। এতে করে মুহুর্তের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আত্মীয়পরিজন। সীমান্ত বন্ধ শুধু নয়, সাধারণের জন্য রেল যোগাযোগও করে দেয়া হয় বন্ধ। সেসবের ইতিহাস এখনো বার্লিনের পাতালরেল স্টেশনে স্থিরচিত্রের সাহায্যে সংরক্ষিত আছে।
১৯৬৩ সালে বার্লিন ওয়াল পরিদর্শনে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যা পরে বেশ বিখ্যাত হয়। তিনি বলেছিলেন, “যত মুক্ত মানুষ আছে, তারা যেখানেই থাকুন না কেন, তারা সকলেই বার্লিনের বাসিন্দা। আর তাই, মুক্তমানব হিসেবে, আমি গর্ব সহকারে বলতে চাই—ইশ বিন আইন বার্লিনের (Ich bin ein Berliner)”। অর্থাৎ আমিও বার্লিনবাসী। দেয়ালের সমালোচনা করেছিলেন কেনেডি। কিন্তু দেয়াল তোলার পর পূর্ব বার্লিনে কিছুটা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছিল। নারীদের মজুরি পুরুষদের সমান করা হয়েছিল। নব্বই শতাংশ নারী চাকুরির সুযোগ পেয়েছিল। 


আবাসন, কাজের সুযোগ, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধার সবটাই সফলভাবে দিচ্ছিল সাম্যবাদী সরকার। শহরে অপরাধ প্রবণতা কমে গিয়েছিল। জনজীবনে ছিল নিরাপত্তা। অনেক পূর্বাঞ্চলবাসী মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে গণতন্ত্র খারাপ জিনিস, এই গণতন্ত্রের কথা বলেই তো হিটলার দেশটিকে নরক বানিয়েছিলেন। যে হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়েছেন, নির্বিচারে ইহুদি ও সমাজতন্ত্রীদের হত্যা করেছেন, সেই হিটলার ও গণতন্ত্রের চাইতে তো সাম্যবাদ শ্রেয়। তবে কি, মানুষ শুধু রুটিতেই বাঁচে না। তার বেঁচে থাকার জন্য আরো কিছু চাই। বিলাসী পণ্য। যেমন- কোকাকোলা, চকোলেট, চুইংগাম। শুনতে হাস্যকর মনে হলেও এটা সত্যি। পুবদিকের মানুষ দেখছে পশ্চিমের জীবনযাপন চাকচিক্যময়। তারা আমোদ প্রমোদে থাকে। কিন্তু পুবদিকে সবকিছু যেন ধূসর। তারা ভেতরে ভেতরে বঞ্চিতবোধ করছিল।


এর ভেতর ভূরাজনীতি পাল্টাতে শুরু করে। আশির দশকে এসে অনেক রাষ্ট্রই, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে, আস্থা হারায় সমাজতন্ত্রের উপর। আশির দশকের একেবারে শেষপাদে সোভিয়েত ইউনিয়নে শোনা যায় ভাঙনের সুর। সোভিয়েত নেতা মিখায়েল গর্বাচেভ নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় আসেন তিনি। এর পরপরই পূর্ব জার্মানিতে লাগতে শুরু করে সংস্কারের হাওয়া। কারণ ততদিনে পূর্ব জার্মানির মানুষ দেশের বাইরে ভ্রমণের দাবি নিয়ে বেশ সোচ্চার হয়েছে। নানামুখী চাপে বার্লিনের পূর্ব-পশ্চিমের ভেদরেখা তুলে দিতে বাধ্য হয় পুবদিকের নেতারা। পূর্বাঞ্চলের মানুষ তখন বানের জলের মতো আছড়ে পড়তে থাকে বার্লিনের দেয়ালে। এত বছর পর মুক্তির স্বাদ! ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে খুলে দেয়া হয় বিখ্যাত ব্রান্ডেনবুর্গ গেট। পরবর্তী কয়েকমাস মানুষ শুধু বার্লিন দেয়ালটিকে ভেঙেছে। এরপর দেয়ালটির আনুষ্ঠানিক ভাঙার কাজ শুরু হয় ১৯৯০ সালের ১৩ জুন। সেই দেয়ালের ভাঙা টুকরো আমি মেমোরিয়াল থেকে সংগ্রহ করেছি, এটা ভাবতেই শিহরণ লাগছে। 


তন্বী বলল, ভালো করেছো কিনে। চলো এবার তোমাকে ব্রান্ডেনবুর্গের দিকে নিয়ে যাই। সেখানে সব বড় বড় দেশের দূতাবাস তো আছেই। আর বিখ্যাত হোটেল অ্যাডলন রয়েছে। সব দেশের ‘জেমস বন্ড’রা নাকি এখানে এসে বৈঠক করে। এবারও ট্রেনে চড়ে বসলাম। পাতাল থেকে উঠেই দেখি আশ্চর্য সুন্দর আকাশ। নীলের জমিনে হলুদ, কমলা ও লালের রেখাচিত্র। কিন্তু পড়ন্ত সূর্যালোকের নিচে কালো পোশাকের জার্মান পুলিশ বেশ যুদ্ধংদেহী মেজাজে দাঁড়িয়ে। কারণ বুঝতে দেরি লাগল না, অদূরেই কিছু মানুষ দেখি ফিলিস্তিনের পক্ষে সমাবেশ করছে।


আমরা সতর্ক দৃষ্টি রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম। ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের দিকে। বিশাল স্থাপত্যকর্ম, চমৎকার তার শৈলী। ১৭০১ সালে যখন বার্লিনকে প্রুসিয়া রাজ্যের রাজধানী করা হয় তখন থেকেই বার্লিনের সামরিক শক্তি বাড়তে থাকে। ভুলে গেলে চলবে না, তখনো কিন্তু জার্মানির জন্ম হয়নি। যাইহোক, রাজা ও রাজ্যের ক্ষমতা বাড়লে, চক্ষু চড়কগাছ হবে সেরকম কিছু একটা করার প্রয়োজন হয়, মানে দেখার মতো একটা ল্যান্ডমার্ক দরকার হয়। তাই এই প্রবেশদ্বার নির্মাণ। যার নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৭৯১ সালে। সেই সময়টি থেকেই কিন্তু বার্লিন নতুন চিন্তাভাবনার কেন্দ্র হয়ে উঠতে শুরু করে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে নতুন নতুন।  ইউরোপের সকল কোনা থেকে দার্শনিক, শিল্পী, কবি ও পণ্ডিতেরা আকৃষ্ট হচ্ছে বার্লিনের দ্বারা। তখনকার একটি জনপ্রিয় গানের লাইনগুলো নাকি এমন ছিল: পাগল হয়েছো বাছা, তবে বার্লিনে যাও!


তো আমারও মনে হচ্ছে পাগল না হলে কেউ এই শীতের ভেতর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে আসে না। হলামই বা পাগল। দুনিয়ায় কিছু পাগল থাকলে মন্দ কি! প্রবেশদ্বার দেখে পায়ে হেঁটে খুব সংক্ষিপ্ত সফরে সাক্ষাৎ করতে গেলাম কার্ল মার্কস আর ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের সাথে। তন্বী বলল, এত কাছে এসেছো, দেখে যাও। কবে আসবে, আদৌ আর আসা হবে কি না। বললাম, তাই হোক। যেতে যেতে বিশাল গির্জা দেখা হলো, বার্লিন ক্যাথিড্রাল, কি তার অঙ্গসৌষ্ঠব! সান্ধ্য আলোতে গির্জাটিকে বড্ড রহস্যময় আর গা ছমছমে মনে হচ্ছিল। তার উপর আবার বিশাল পাখিদের ঝাঁক, পরিবেশটাকেই কেমন ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল। রাস্তার এপার থেকে দেখে পা বাড়ালাম মার্কস-এঙ্গেলস ফোরামের দিকে। বার্লিনের স্প্রি নদীর কোল ঘেষে চমৎকার এই পার্কে রাখা আছে দুই বন্ধুর চমৎকার মূর্তি। পূর্ব জার্মান সরকার অর্থাৎ জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক ১৯৮৬ সালে এই পার্কটি নির্মাণ করে। দুই মহাত্মাকে ঠাণ্ডার ভেতর আমি প্রণাম ঠুকে, মানে ছবিটবি তুলে তন্বীকে বললাম, চলো এবার যাওয়া যাক।


ও এবার বাসযোগে আমাকে নিয়ে চলল রাতের খাবার সারতে। ইয়র্কস্ট্রস এলাকায় নাকি একটা খুব জম্পেশ রেস্তোরাঁ আছে, নাম ইয়র্কস্লসশেন: লাইভ জ্যাজ অ্যান্ড ব্লুজ। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে জ্যাজ অথবা ব্লুজ শুনতে শুনতে খাওয়া যায়। তন্বী জানালো খাবারটাও ভালো। অবশ্য আমাকে ও আগে জিজ্ঞেস করে নিয়েছে খাঁটি জর্মন খাবার খেতে চাই কি না। আমি বললাম, আলবৎ, ওটাই তো খাব। এখানে এসে বাঙালি খাবার খুঁজতে যাব কেন? তন্বী খুশি হয়ে তাই ওখানটায় নিয়ে গেল। কপাল মন্দ। গানবাজনা আজ হচ্ছে না, কারণ শিল্পী পাওয়া যায়নি। বেশ পুরোনো ধাচের রেস্তোরাঁ। চারিদিকে বিখ্যাত সব জ্যাজ ও ব্লুজ শিল্পীদের ছবি, রেকর্ড, পোস্টার সাটানো। এক ফাঁকে দেখলাম তাকে রাখা আছে লাল ভল্লুক, অর্থাৎ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের স্ক্রিনিং শিডিউল। 

 

তন্বী বলল, জার্মানি এসেছো বিয়ার খাবে না, তা কি করে হয়। সেটাই তো! তরল ভল্লুকের রকমফের অনেক। তন্বী নিল নন-এলকোহলিক হেফেওয়াইৎজেন, আর আমারটার নাম ক্রিস্টাল ওয়াইৎজেন। মেইনডিশে অর্ডার করা হলো স্নিৎজেল (Schnitzel), আমার জন্য। এটা অনেকটা দেখতে ফিশ অ্যান্ড ফ্রাইয়ের মতো, কিন্তু আসলে ওখানে ফিশের বদলে মাংসের কাটলেট। হাতুড়ি দিয়ে পর্কের মাংস থেতলে বানানো হয়। সঙ্গে আলু ভাজি। তন্বী নিল সোয়াবিশে মাওয়ালটাশেন (Schwäbische Maultaschen), এটি অনেকটা আমাদের দেশের ডিম দেয়া মোগলাই পরোটার মতো। কিন্তু এরা এর সাথে ব্যাপক সালাদ দেয়।


রাতের খাবার শেষ হতে হতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। তাপমাত্রা দেখলাম মাইনাস তিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তো রেস্তোরাঁ থেকে দ্রুত হেঁটে স্টেশনের দিকে গেলাম। বাসায় ফিরতে হবে। সারাদিন প্রচুর দৌঁড়াদৌঁড়ির ভেতর একটা জিনিস কিন্তু আমার চোখ এড়ায়নি, সেটি হলো ল্যাম্পপোস্টে হিটলারকে আইকন করে মারা স্টিকার। উগ্রবাদের উত্থান ও পতন সামাজিক নিয়ম মেনেই হতে থাকে বিভিন্ন রাষ্ট্রে। এরও বোধহয় নিজস্ব বৃত্ত রয়েছে, যা থেকে সৃষ্টি হয় ইতিবৃত্ত।  

Link copied!