পরিচালক বিক্রমাদিত্য মতওয়ানের অ্যামাজন প্রাইমের নতুন হিন্দি ওয়েব সিরিজ ‘জুবিলি’ দিয়ে প্রথমবারের মতো হিন্দি ওয়েব সিরিজে আত্মপ্রকাশ করলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ সালের হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রেক্ষাপটে এই ওয়েব সিরিজের মূল কাহিনীর স্রষ্টা দুজন। একজন পরিচালক বিক্রমাদিত্য মতওয়ানে। দ্বিতীয়জন সৌমিক সেন। প্রসেনজিৎ ছাড়াও ওয়েব সিরিজটিতে অভিনয় করেছেন অপারশক্তি খুরানা, অদিতি রাও হায়দরি, ওয়ামিকা গাব্বি, রাম কাপুর, সিদ্ধান্ত গুপ্তার মতো অভিনেতারা। এই ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন অতুল সব্রওয়াল। মোট দশ পর্বের প্রথম পাঁচ পর্ব ৭ এপ্রিল অ্যামাজন প্রাইমে শুরু হয়েছে।
এই ওয়েব সিরিজের প্রেক্ষাপট হিসেবে ১৯৪০ থেকে ১৯৫৯ সালের মোটামুটি দশ বছরের বিশেষ সময়কে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে পরিচালক বিক্রমাদিত্য বলেন, “হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ওই বিশেষ সময়টিকে নিয়ে আমাদের মতো অনেক সিনেমা ভক্তদের মনে কৌতূহল রয়েছে। ওই বিশেষ সময়সীমায় ভারতের হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়েছে, যারা পরবর্তীকালে হিন্দি সিনেমার পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। সেটা অশোক কুমারই বলুন, অথবা রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার, গুরু দত্ত, দেব আনন্দ কিম্বা নার্গিস, মধুবালাদের কথাই বলুন। এদের আবির্ভাবের সময়টিকে জানার ইচ্ছা পরিচালক হিসেবে আমার যেমন, তেমনই পুরনো ও নতুন প্রজন্মের দর্শকদের রয়েছে। ওই বিশেষ সময়সীমার কাহিনীকে তুলে ধরার একটা তাগিদ অনেকদিন ধরে অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল, হিন্দি সিনেমার পথিকৃৎদের জীবন শুরু করার ওই কাহিনীকে পুরনো প্রজন্ম তো বটেই নতুন প্রজন্মের কাছে বলাটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ওয়েব সিরিজের পরিচালক হিসেবে আমি এই গল্পকে কিছুটা আমাদের নিজেদের কল্পনাশক্তি মিশিয়ে বলতে চেয়েছি।”
বস্তুত আজ থেকে আশি-বিরাশি বছর আগের ‘বম্বে’কে ২০২৩-এ দাঁড়িয়ে ধরতে গিয়ে পরিচালক বিক্রমাদিত্যকে বিশাল পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। অথচ এ ধরনের বিশেষ সময়ের গল্প পর্দায় বলতে গেলে তার পুরো পারিপার্শ্বিক ধরাটা অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই স্টিম ইঞ্জিন, বা পুরনো রেল স্টেশনের পরিবেশ তৈরি করতে গিয়ে পরিচালক বিক্রমাদিত্যকে শ্রীলঙ্কায় যেতে হয়েছে। কেননা শ্রীলঙ্কায় পুরনো সময়ের সেই স্টিম ইঞ্জিন বা রেলস্টেশন সেভাবেই সংরক্ষিত আছে। অন্যদিকে ‘জুবিলি’ ওয়েব সিরিজের জন্য মুম্বাইয়ের লিবার্টি কিংবা অ্যালফ্রেড সিনেমা হলগুলোর ভেতরের অংশে ‘রয় টকিজ’-এর ইন্টেরিয়র দৃশ্যগুলির শুটিং করা হয়েছে। তেমনই চল্লিশ দশকের বম্বেকে ধরার জন্য শুটিং ফ্লোরে তৈরি করা হয়েছে পুরনো দিনের বম্বে শহরের পরিবেশ।
বিক্রমাদিত্য মতওয়ানের ‘জুবিলি’ ওয়েব সিরিজের এই ‘রয় টকিজ’ যে আসলে হিমাংশু রাই এবং দেবিকা রানীদের ‘বম্বে টকিজ’, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত রয়’ যে আসলে হিমাংশু রাই, অদিতি রাও হায়দরির চরিত্রটি যে আসলে দেবিকা রানী কিংবা আয়ুষ্মান খুরানার ছোট ভাই অপারশক্তি খুরানার চরিত্র ‘মদন কুমার’ যে অশোক কুমারকে মাথায় রেখেই স্কেচ করা হয়েছে, তা বোঝা যায়।
১৯৩৪ সালে মুম্বাইয়ের পশ্চিম শহরতলির পশ্চিম মালাডে ‘বম্বে টকিজ’ নামে হিন্দি সিনেমার আধুনিক ও অভিনব স্টুডিও থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন দেবিকা রানী, অশোক কুমার, দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, মেহমুদ, মধুবালাদের মত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে লন্ডনে আইন পড়তে যাওয়া কলকাতার সম্ভ্রান্ত পরিবারের হিমাংশু রাই, আইন পড়ার ফাঁকে থিয়েটার এবং পরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পালের ছেলে নিরঞ্জন পালের সঙ্গে সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা শেখা এবং সিনেমা দেখার পরিচয়। জার্মানির মেয়ে মেরিলিন হেইলিনের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে। নিরঞ্জন পালের মাধ্যমেই হায়দ্রাবাদ থেকে লন্ডনে আসা রবীন্দ্রনাথের নাতনি দেবিকা রানীর সঙ্গে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে। ১৯২৯ সালে দেবিকা রানীকে বিয়ে করে তাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে ফিরে আসা এবং ১৯৩৪ সালে তৎকালীন বম্বের মালাডের পশ্চিমে ‘বম্বে টকিজ’ প্রতিষ্ঠা করা। ডানাকাটা সুন্দরী দেবিকা রানীর ছবিতে নায়িকা হওয়া। বয়সে দশ বছরেরও বেশি বড় স্বামী হিমাংশুর সঙ্গে দেবিকার দাম্পত্য জীবনে টানাপড়েন, বম্বে টকিজের প্রযোজনায় ‘জীবন নাইয়া’ ছবির শুটিংয়ের শুরুতেই হ্যান্ডসাম নায়ক নাজাম উল হুসেনের (‘জুবিলি’ ওয়েব সিরিজে নাজামুলের চরিত্রের নাম ‘জামশেদ খান’ করা হয়েছে। যে জামশেদ খান চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন নন্দিশ সিং সন্ধু) সঙ্গে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া, চিড় খাওয়া দাম্পত্যকে জোড়া লাগাতে আবার কলকাতা থেকে মুম্বাই ফিরে আসা, হিমাংশু রাইয়ের অকাল মৃত্যু, দেবিকা রানীর অধীনে আসা বম্বে টকিজের পতন, ওই সংস্থার অন্য কর্ণধারদের অন্যতম শশধর মুখার্জির সঙ্গে মতভেদ, ‘বম্বে টকিজ’-এর দায়িত্বভার ছেড়ে দিয়ে কিংবদন্তি রাশিয়ান চিত্রকর নিকোলাস রোরিকের ছেলে স্পেতোস্ল্যাভ রোরিককে বিয়ে মুম্বাই ছেড়ে বেঙ্গালুরুতে চলে যাওয়ার মত নানা বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে, এমনকি ৪৭-এর দেশভাগের পটভূমিকেও এর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বিক্রমাদিত্য মতওয়ানে এবং সৌমিক সেন পিরিয়ড ড্রামা হিসেবে হিন্দি ওয়েব সিরিজ ‘জুবিলি’র দশটি পর্বকে বুনেছেন। ৭ এপ্রিল এই ওয়েব সিরিজের প্রথম পাঁচটি পর্বের পর দ্বিতীয় অংশের পাঁচটি পর্ব অ্যামাজন প্রাইমে রিলিজ হবে ১৪ এপ্রিল।