• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫, ২৮ চৈত্র ১৪৩১, ১২ শাওয়াল ১৪৪৬

মরুর দেশে ‘প্রিয় মালতী’র দর্শন


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৪, ১০:৩২ এএম
মরুর দেশে ‘প্রিয় মালতী’র দর্শন
কায়রো উৎসবে প্রিয় মালতীর সহপ্রযোজক রেদওয়ান রনি, অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী, প্রযোজক আদনান আল রাজীব ও নির্মাতা শঙ্খ দাশগুপ্ত। ছবি: চরকির সৌজন্যে

ছোট পর্দার প্রিয় মুখ অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী। বড় পর্দায় নাম লিখিয়েছেন সম্প্রতি। ক্যারিয়ারের অসংখ্য নাটকের মাধ্যমে ভক্তদের মন কেড়েছেন। নাটকের পাশাপাশি ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেও সুনাম কুড়িয়েছেন। ক্যারিয়ারে ইতোমধ্যে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য হিট নাটক। শুধু তাই নয়, ওয়েব ফিল্মেও নিজের অভিনয়গুণে নজর কেড়েছেন দর্শকদের। 

কাজ করছেন সিনেমায়ও। শিগগিরই মুক্তি পেতে যাচ্ছে মেহজাবীন অভিনীত সিনেমা ‘প্রিয় মালতী’। এর আগে মরুর দেশ কায়রো মাত করে এলো তার অভিনীত সিনেমা  ‘প্রিয় মালতী’।
কায়রো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে।

আলোচিত এই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন ‘প্রিয় মালতী’। তাদির প্রতিনিথিত্ব করেছেন নির্মাতা রেদোয়ান রনি। তার লিখায় দেখুন মরুর দেশে ‘প্রিয় মালতী’।

 হ্যাল। ‘ডিয়ার মালতী‍‍` টিম ফ্রম বাংলাদেশ’ ঘোষণাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আরও সতেজ হয়ে উঠলাম সবাই। নির্মাতা শঙ্খ দাশগুপ্ত, অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী, পরিচালক-প্রযোজক আদনান আল রাজীব এবং আমি তখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি কায়রো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, এ মুহূর্তে বিশাল এক রেড কার্পেটে প্রবেশের ঠিক আগমুহূর্তে। ২২ নভেম্বর ছিল উৎসবের গালা নাইট। লালগালিচা, শত শত ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ, আলোর ঝলকানি বিভিন্ন দেশর খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকারদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত। সেখানে ‘প্রিয় মালতী’ (ইংরেজিতে ‘ডিয়ার মালতী’) আর বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করার সময় বুকের মধ্যে যে প্রতিধ্বনি হয়, তা লিখে প্রকাশ করা কঠিন।

তিন স্তরের ফটোশুট শেষ করে আগাচ্ছিলাম,  উৎসব কর্তৃপক্ষ এসে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কথা বলার জন্য নাম ধরে ডাকল মেহজাবীন আর শঙ্খকে। এই কয় দিনে প্রতিটি প্রোগ্রামে, নেটওয়ার্কিং পার্টি, সেমিনারে ‘প্রিয় মালতী’ প্রশংসায় ভেসেছে। 

লাইমলাইটে থাকা ফিল্মগুলোকে দেখলাম প্রেসের সামনে একটু বেশিই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ঠিক পরপরই অপেরা হাউসের সামনে দেখা হলো উৎসব প্রেসিডেন্ট হুসেন ফাহিমের সঙ্গে। তার কথা শুনে আমার সেই ধারণা স্পষ্ট হলো। তিনি বললেন, ‘বেস্ট অব লাক। বাংলাদেশের সিনেমাটি নিয়ে এবার খুব আলোচনা হচ্ছে।’

এ আলোচনার শুরু ১৫ নভেম্বর। ওই দিন হয় সিনেমার প্রথম প্রদর্শনী। প্রিমিয়ার শোতে আমি থাকতে পারিনি, আমি পৌঁছাই কায়রো সময় ১৬ নভেম্বর দুপুরে। গিয়েই নীল নদের পাড়ে সফিটেল হোটেলের খাবার টেবিলে, সঙ্গে ‘প্রিয় মালতী’ টিম। তারা উৎসবে আমার আগে পৌঁছেছে। খাচ্ছি আর প্রথম শোর দর্শক–সমালোচক প্রতিক্রিয়া শুনছি। জানতে পারলাম, বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব গল্প আর একদম খাঁটি দেশি চরিত্র হলেও মালতী চরিত্রটির স্ট্রাগল সহজেই অনুধাবন করতে পেরেছেন ভিনদেশি দর্শক আর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা চলচ্চিত্র সমালোচকেরাও। ‘লোকাল ইজ গ্লোবাল’ এই নতুন ফেনোমেনাই আবারও মনে করিয়ে দিলাম নিজেকে।

কায়রোর নীল নদের পাড়ে তখন সারিবদ্ধভাবে নৌকা বাঁধা, আর কয়েকটা ভাসছে। ভেসে আসছে আরবীয় গানের সুর। ছায়াশীতল পরিবেশে মিষ্টি খাবারটার স্বাদটা বেড়ে গেল বহুগুণে। দৃশ্যটা আপনারাও যেমন ভাবছেন, আমিও কল্পনায় আঁকছিলাম দর্শক প্রতিক্রিয়ার ওই মুহূর্তগুলো।

 

 

দ্বিতীয় দিন, ১৭ নভেম্বর, আমার অদ্ভুত অভিজ্ঞতার দিন। কম বয়সেই সিনেমার পোকা যখন মাথায় কিলবিল করছিল, তখন ‘ইরেভারসিবল’ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এভাবেও গল্প বলা যায়! মনিকা বেলুচ্চির টানেলের দৃশ্যটা নিয়ে বারবার ভেবেছি। কীভাবে সম্ভব এত রিয়েলিস্টিক দৃশ্য ধারণ করা? তার ‘লাভ’ সিনেমার পোস্টার এখনো আমার বাসায়! সেই মাস্টার আর্জেন্টাইন–ফ্রেঞ্চ ফিল্মমেকার গ্যাসপার নুয়ে শিক্ষক হয়ে আসেন আমার সামনে। তার মাস্টারক্লাসে অংশ নিই আমি, আদনান, শঙ্খ ও তারেক। কত কথা, গল্প, নির্মাণের কলাকৌশল নিয়ে আলাপ আর অদ্ভুত প্রশ্নোত্তর! কী যে ভালো লাগা। 

একই হেটেলে থাকার সুবাদে পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে তাঁকে পাশে পেয়ে যান নির্মাতা শঙ্খ দাশগুপ্ত। বাংলাদেশের কথা শুনে গ্যাসপার জানতে চান, এ দেশের মানুষেরা তাঁর সিনেমা দেখেন কি না? উত্তরে শঙ্খ জানান, ‘আমরা আপনার ভক্ত।’ এটা শুনে তিনি অবাক হন এবং ‘প্রিয় মালতী’র ট্রেলার দেখেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং ভিজ্যুয়াল!’

উৎসবে ‘প্রিয় মালতী’র দ্বিতীয় শো এবং আমার দেখা প্রথম শো ছিল ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায়। সেটা দেখতে গিয়ে প্রথম ধাক্কাটাই লাগে হলভর্তি দর্শক দেখে। যা আমার কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। সিনেমা শেষে মেহজাবীনকে দেখে দর্শকদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। আমি ভাবছিলাম, দাঁড়িয়ে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখব-শুনব।

কিন্তু দর্শক-সমালোচকদের মন্তব্য এবং মেহজাবীনকে শুভেচ্ছা দেওয়ার দৃশ্যগুলো ভিডিও না করে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, তাঁরাই যেন আমাদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন বাংলাদেশের। সমালোচক রিভিউগুলো চরকির সোশ্যাল মিডিয়া পেজে গিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, বাংলাদেশের মালতী তাদের কত প্রিয় হয়ে উঠেছে।

মিসরে এসে পিরামিড না দেখে গেলে কেমন হয়? পিরামিড আর ফেরাউনের মমি দেখে ঘুরেটুরে ওই রাতেই আমরা একটা নেটওয়ার্কিং প্রোগ্রামে অংশ নিলাম। মরোক্কান নাইট নামে একটি ইভেন্টে গিয়েছিলাম আমরা। সেখানে অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। তবে বলতে চাই কায়রোর প্রভাবশালী একটা স্থানীয় দৈনিকের সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপের ঘটনাটা। 

পরিচয়ের শুরুতেই জানালেন, ‘প্রিয় মালতী’ নিয়ে তিনি ফিচার করেছেন। এটা জেনে নির্মাতা শঙ্খকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিতেই তিনি বললেন, ‘আরে! আমি তার (শঙ্খ দাশগুপ্ত) ছবি ছাপিয়েছি সেই ফিচারে।’ সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোন বের করে দেখিয়ে দিলেন নিউজের ডিজিটাল কপি। দেখলাম, শঙ্খর ছবি ‘প্রিয় মালতী’র ছবিসহ আরবিতে লেখা এক বিশাল ফিচার। এক শব্দও না পড়তে পারলেও ভালো লাগছিল দেখে। মজা করে বলছিলাম, যা লিখেছে, হয়তো ভালোই লিখেছে। এরপর নিজেই তরজমা করে বলল, ফিচারে লেখা হয়েছে বাংলাদেশের সিনেমার মুগ্ধতার কথা।

এমন অনেক ঘটনাই আমাদের আশাবাদী করে তুলেছিল পুরস্কারের বিষয়ে। ক্লোজিং সেরিমনি ২২ নভেম্বর পুরস্কার বিতরণীতে দেখলাম, পুরস্কার পেয়েছে মর্যাদাপূর্ণ ফেস্টিভ্যালের পুরস্কার পাওয়া সিনেমা আর জয়জয়কার হয়েছে প্যালেস্টাইনের বেশ কয়েকটি ফিল্মের। কিন্তু তাতে কোনো দুঃখ হচ্ছে না। যে সম্মান, প্রশংসা ও ভালোবাসা পেয়েছি, সেটা পুরস্কারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সেটা বরং আমাদের চ্যালেঞ্জটা বাড়িয়ে দিয়েছে আগামী দিনে, সেদিন খুব দূরে নয়, দেখব, এই মঞ্চেই বাংলাদেশি কোনো নির্মাতার হাতে পুরস্কার আর আমাদের উচ্ছ্বাস!

ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ইন্ডিয়ায় ‘প্রিয় মালতী’র অফিশিয়াল সিলেকশনের খবর। নির্মাতা শঙ্খ আর নির্বাহী প্রযোজক তারেক কায়রো থেকে রওনা করছে গোয়ার উদ্দেশে, এবার আমাদের দেশে ফেরার পালা। একবুক আশা নিয়ে ফিরছি মরুর দেশ থেকে। বাংলা চলচ্চিত্রের যে জয়জয়কার শুরু হয়েছে, মেধাবী তরুণ নির্মাতারা বিশ্বের অনেক মর্যাদাপূর্ণ ফেস্টিভ্যালে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে, পুরস্কার পাচ্ছে, ক্রিটিক রিভিউর লাইমলাইটে চলে এসেছে অনেক বছর ধরেই আর প্রতিনিয়তই আসছে নতুন আশাজাগানিয়া খবর; যেগুলো দেশের সিনেমাকে করবে সমৃদ্ধ। বিশ্বের বুকে বাংলা চলচ্চিত্রের জয়ের যাত্রা চলবেই।

Link copied!