সরোজ খানকে নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের চলে যেতে এ উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি, দেশভাগের দিনগুলোতে। তখনও অবশ্য তিনি জন্ম নেননি। তার পরিবার ছিল যথেষ্ট বড়লোক। থাকতেন পাকিস্তানে। এক রাতের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে পরিবার ভারতে আসার জন্য বের হয়। সঙ্গে ছিল কাপড়ের ব্যাগ আর স্বর্ণের ব্যাগ। ভাগ্যের পরিহাসে ব্যাগ বদলে গেল এত মানুষের ভিড়ে। বোম্বের এক রিফিউজি ক্যাম্পে হলো আশ্রয়। ১৯৪৮ সালে সরোজ খানের জন্ম হয়।
তিন বছর বয়সে সরোজ খানের মা দেখলেন আয়নায় হাত পা ছুঁড়ে নাচে। ভাবলেন মেয়ের কোনো মানসিক সমস্যা। সরোজ খানের মা তখন আরেকবার গর্ভবতী, চেক আপে গিয়ে ডাক্তারকে বলেন, “আমার মেয়ে এরকম কেন?” ডাক্তার বলেছিলেন, “আপনার মেয়ে ঠিক আছে। তাকে নাচ শেখাতে পারেন কিনা দেখেন? যদি সিনেমায় যদি শিশু ড্যান্সার হয় তাহলে রোজগারের আর ভাবনা নাই, সে একাই পরিবার চালাতে পারবে।” সেই ডাক্তারই তাকে সিনেমায় নিয়ে যান পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে। মাত্র তিন চার বছর থেকেই তিনি নিজের পরিবার চালান। ড্যান্স গ্রুপেও অনুষ্ঠান করেন। নয় দশ বছরে কাজ ওনার কমে গেল। সিনেমার আর কাজ আসে না। তো তিনি খুব ভালো ওয়েস্টার্ন ড্যান্স শিখেছিলেন। এক্রোব্যাটিক, ক্যাবারে এসবও পারতেন। চুল ছোট রাখার কারণে তাকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভাবতেন অনেকে। এরপর তিনি নায়িকাদের সঙ্গে নাচতেন। মাত্র তের বছর বয়সে তার এক ড্যান্স মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে হয়। একটা ছেলেও হয়, কিন্তু তখনকার স্বামী সন্তানকে মেনে নেননি। তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।
সরোজ খান তখন একা একা ট্রেইনার হিসাবে কাজ করতেন। সিনেমায় বিখ্যাত সব নায়িকাদের নাচের স্টেপ প্র্যাকটিস করাতেন। একবার এক ড্যান্স মাস্টার অনুপস্থিতিতে তিনি কোরিওগ্রাফার হিসাবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু তখন তামিল মাস্টাররাই এ কাজটা করতো। বলিউডে তাদের এ কাজে সুনাম ছিল। নায়িকা সাধনা প্রযোজিত ‘গীতা মেরে নাম’ ছবি দিয়ে তার একক কোরিওগ্রাফার হিসাবে কাজ শুরু।
কিন্তু লোকজন একটা মেয়েকে কোরিওগ্রাফার বা ড্যান্স মাস্টার হিসাবে মানতে চাইতো না। বলিউডে তখন সেক্সিজমের আখড়া। তিনি বড় সিনেমায় কাজ পেতেন না। হেমা মালিনীর এক ছবিতে কাজ পেয়ে নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি। তবে তাকে বদলে দেয় ‘তেজাব’ ছবির কাজ। একটা গানের নৃত্য পরিচালনা করেই তিনি রাতারাতি বলিউডে বিখ্যাত হয়ে যায়। প্রযোজক তাকে বলেছিলেন, ‘আপনার একটা ড্যান্সই আমার কপাল খুলে গেছে।’ এর আগে কোরিওগ্রাফি শব্দটা ব্যবহার হতো না। সরোজ খানকে দিয়েই শুরু। তিনি তখন এক গানে পারিশ্রমিক নিতেন ১৫ হাজার, সেই ছবির পরেই তা এক লাখে ঠেকলো। ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারে নাচের ক্যাটাগরি শুরু হলো। তিনি ফিল্মফেয়ার পেলেন প্রথমবারেই। সেই থেকে তার উত্থান শুরু।
হিন্দি সিনেমায় জম্পেশ নৃত্য মানেই সরোজ খানের নির্দেশনা। এ পর্যন্ত আটটা ফিল্মফেয়ার তিনি পেয়েছেন কোরিওগ্রাফার হিসাবে। তিনটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার যুক্ত হয়েছে তার মুকুটে। জেনারেশনের পর জেনারেশনের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। শ্রীদেবী অভিনীত সেই কালজয়ী নাচ ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’তে, কে ভুলতে পারে। বিখ্যাত নায়িকা মাধুরী দীক্ষিত তার এত অর্জনের জন্য অন্যতম কৃতিত্ব দেন সরোজ খানকে। দেবদাস সিনেমায় ‘দোলারে দোলারে’ এখনও আপনার মনে দোলা দেবেই। ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সে আইকনিক নাচ ‘হাম আপকা হ্যায় কউন’ ছবিতে কত অসাধারণ। এই তো সেদিন ‘কালংক’ ছবিতে আবার মাধুরীর সঙ্গে কাজ করলেন। টেলিভিশনে রিয়েলিটি শোর বিচারক হিসাবেও ছিলেন তিনি বিখ্যাত।
অনেকেই জানেন না, তার আসল নাম, নির্মলা নাগপাল। আবার যখন ভালোবেসে বিয়ে করেন সে স্বামীর নাম ছিল সরদার খান। সেখান থেকেই নিজের ডাক নামের সঙ্গে হয়ে যায় সরোজ খান। তাদের ছিল সুখের সংসার। ইন্ডাস্ট্রিতে তাকে ডাকতেন সবাই ‘মাস্টারজি’ বলে। সরোজ খানের জীবন অবসানের সঙ্গে সঙ্গে চলে গিয়েছিল এক নারীর বলিউডের সংগ্রামের গল্পও। তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও ভালোবেসে স্মরণ।