বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের একটি বৈশিষ্ট্যের কথা দুনিয়ার লোক জানে, সেটি হলো বার্লিনালে একটু রাজনীতিঘেষা ছবি দেখাতে পছন্দ করে। মানে সামাজিক ন্যয়বিচার, মানবাধিকার ও নানা ধরনের তৎপরতার ছবি বার্লিনালে স্বাগত জানায়। তো সেই বৈশিষ্ট্যের দেখা শেষতক মিলেছে আমার দেখাতে। মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবসে এমন এক ছবি দেখেছি, যেটি আসলে ভালোবাসার কথা নয়, বলেছে দেশ ও রাজনীতির কথা। সেই আলাপে প্রবেশের আগে বলে নিতে চাই, এদিনই আমাদের ফিপ্রেসির তরফ থেকে ক্রিটিক জুরিদের নিয়ে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো।
আমাদের বৈঠক হওয়ার কথা গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলের বোর্ডরুমে। এদিন একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। স্টেশন থেকে নেমে শীতটা অতো তীব্র লাগল না। তবে কি গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে? তাপমাত্রা কিন্তু হিমাঙ্কের ঘরেই আছে। বরং আগের রাতে পাঁচে নেমে গিয়েছিল। চারদিকে শুধু সাদা আর সাদা। পুরু হয়ে বরফ জমে আছে। স্টেশনের উপরের খোলা চত্বরে একঝাঁক পায়রা, এই শীতের ভেতরেই থেকে থেকে ওড়াউড়ি করছে। পাতাঝড়া বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার ফাঁক দিয়ে তাদের চক্রাকার উড়াল বেশ মনোরম লাগছে। আমি হেঁটে হেঁটে গ্র্যান্ড হায়াতের দিকে এগুচ্ছি। দেখি শীতের ভেতরেই তারকারা হোটেলে আসা শুরু করেছে। লোকজনের ভিড়। সঙ্গে সাংবাদিক।
আমি আর খোঁজ নিলাম না কোন তারকা। জটলা পাশ কাটিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। দোতলায় উঠে বোর্ডরুমের সামনে দাঁড়িয়েছি। দরজাটা লক করা। দেখি আমার একটু পরই এক ভদ্রমহিলা এলেন। বয়স পঞ্চাশের এদিকসেদিক। বোঝা গেল তিনিও ফিপ্রেসি মিটিংয়ে এসেছেন। হাসিমাখা মুখে আমার সাথে কুশল বিনিময় করে জানালেন তিনি ব্রাজিল থেকে এসেছেন। নাম ইভোনেতে পিন্টো। ব্রাজিল শুনেই বললাম, তোমাদের ব্রাজিলের ফিল্ম ক্রিটিক, রিও ডি’জেনেরিওতে থাকে, মার্সেলো জেনোত, তাকে চেনো? পিন্টো সাথে সাথে বলল, অবশ্যই। আমি কিভাবে চিনি? বললাম, মার্সেলোর সাথে আমার রিয়াদের এক সম্মেলনে পরিচয় হয়েছিল। বেশ হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। ওর ছেলের জন্য ফুটবলার রোনালদোর জার্সি কিনেছে রিয়াদ থেকে।
আলাপচারিতা করতে করতে দেখি এক হ্যাংলাপাতলা ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসছেন, ছোট করে ছাটা চুল। কালো ব্লেজার আর প্যান্ট পরা। কাছে এসে পরিচয় দিল ওর নাম সারা ডা’সেনজো। ইতালির প্রখ্যাত পত্রিকা ‘কুরিয়েরে’ আর্ট অ্যান্ড কালচারাল পাতার এডিটর। ইতালি থেকে আসছে শুনে বললাম, তোমার দেশের পাওলা ক্যাসেলা আমার খুব পরিচিত। সারা সাথে সাথে বলল, আরে বার্লিনালে তো পাওলাই আমাকে পাঠিয়েছে, ওই স্পন্সর করেছে আমাকে। আমি বললাম, বাহ। দুনিয়া তো দেখি আসলেই অনেক ছোট।
মিটিংরুম খুলে দিতে এগিয়ে এলো বার্লিনে অবস্থানরত আমাদের সমন্বয়ক শায়ান রিয়াজ। ততক্ষণে প্রায় সকলেই উপস্থিত হয়েছেন। এবার ৭৫তম বার্লিনালে ফিপ্রেসি জুরিদের একটা তালিকা দেয়া উচিত: আহমেদ শাওকি (মিশর), মাজা কোরবেকা (পোল্যান্ড), ফ্রান্সিস রোমেরো পেজোয়া (চিলি), আরিয়েল শুয়েতজার (ফ্রান্স), বিধান রিবেরু (বাংলাদেশ), ইভোনেতে পিন্টো (ব্রাজিল), টিমি চিন-টিং চেন (হংকং), সোফিয়া আলভারেজ সালাস (পেরু), সারা ডা’সেনজো (ইতালি), অলিভিয়া পপ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ও সেরিস হাওয়ার্ড (অস্ট্রেলিয়া)।
তো এদের ভেতর পার্সপেক্টিভস সেকশনের জুরি তিনজন। সারা, অলিভিয়া ও আমি। অলিভিয়া ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বার্লিনে এসেছে মাস্টার্স করতে। কিন্তু সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। বছর দুয়েক ধরে সে জার্মানিতে থাকছে। এবারের জুরি প্রেসিডেন্ট আহমেদ শাওকি। ওর সভাপতিত্বে বৈঠক হলো, এরপর ছবিটবি তোলার পালা। সাবজুরি মিটিংয়ে আমাদের দেখা ছবিগুলো নিয়ে আলাপ করলাম। সবারই গড়ে তিনটা ছবি দেখা হয়েছে। আমি দেখেছি চারটা। তো সেসব নিয়ে আলাপ করতে করতে স্ক্রিনিংয়ের সময় ঘনিয়ে এলো। শুরুতে যে কথাটি বলছিলাম, রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, সেটি দেখতেই ছুটলাম ব্লুম্যাক্স থিয়েটারে।
কন্সট্যাঞ্জ ক্লাউ পরিচালিত জার্মান ছবি ‘পাঞ্চিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ (২০২৫), ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক নিজেই। একটি পরিবারের আন্তঃসম্পর্ককে পুঁজি করে একটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন নির্মাতা। দুই ভাই, বড়জনের নাম ফিলিপ, আর ছোটজনের নাম টবি। তারা একটি বাড়ি নির্মাণ করছে। এই নির্মাণের দৃশ্য প্রায় পুরো ছবি জুড়েই ছিল। আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এটি। এ যেন রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ। ধীরে ধীরে দেখা যায়, পূর্ব জার্মানির এক প্রদেশে থাকা পরিবারটি আধা-নির্মিত বাসাতেই উঠে যায়। বাসা পুরোপুরি ঠিক করা যায়নি, কারণ উবে নামে যে লোকটি তাদের সহযোগিতা করছিল, পূর্ব জার্মানির সাম্যবাদী সরকারের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল, সে মারা যায়। তার মৃত্যুর পরপরই দেখা যায় দৃশ্যে আগমন ঘটে একদল তরুণের, যারা নব্য নাৎসি, উগ্র স্বভাবের। পাথরে শুধু নাৎজি চিহ্ন নয়, শরণার্থীদের বাড়িঘরে হামলা, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে আগুন, নিরীহ প্রাণীকে হত্যা এহেন কোনো কাজ নেই তারা করে না। ঘটনাচক্রে তাদের সাথে জড়িয়ে পড়ে ফিলিপ। আধা প্রস্তুত বাসাটিতে আসার পর থেকেই নানা বিপর্যয়ের ভেতর একটি—বড় ভাই ফিলিপের নব্য নাৎসিদের সাথে জড়িয়ে পড়া। তাদের বাবার নতুন সম্পর্ক হওয়া, মায়ের মানসিক প্রশান্তি নষ্ট হওয়া ইত্যাদি তো আছেই।
দশ বছর পর যখন ফিলিপ ও টবি আরো বড় হয়ে যায়, তখন যেন নব্য নাৎসিরা আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। দেখা যায় তাদেরই পুরোনো স্কুলে শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্র খোলাকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ তৈরি হয়। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয় স্কুলটিতে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে। সাবালক টবি তখন সেখানে ছিল। পরবর্তীকালে অদূরের এক মেলায় চরকিতে বসে, স্কুলে দেয়া আগুন দেখতে থাকে সে। এ তো শুধু স্কুল নয়, তার শৈশবও। পুড়ে যাওয়া স্কুলের সামনে ব্যানার ঝুলছিল একটা, তাতে লেখা ছিল ‘আমাদের ভবিষ্যৎ শিশুদের জন্য’। প্রশ্ন হলো কোনটা ভবিষ্যতের জন্য ভালো, আর কোনটা মন্দ? দুই ভাইয়ের বাবা নতুন সংসারে কেমন নিষ্প্রভ, মৃয়মান, মৃত মানুষের মতো। তাদের মা একা, উদভ্রান্ত, আর উদাসীন। নির্মাতা যেন এই চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে বলতে চাইলেন নব্য নাৎসিদের উত্থান দেশটির জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। ছবির ভেতর অসংখ্য জায়গায় হিটলারকে গালাগাল দেয়া সংলাপ রয়েছে। দুই ভাই কি পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির রূপক? হতে পারে!
পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানি মিলে গেলেও, বৈশ্বিক নানা সংকট তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও সেখান থেকে আসা শরণার্থী একটা বড় সংকট। আমি ব্রান্ডেনবুর্গ গেইট থেকে ফেরার পথে দেখেছি রুশ দূতাবাসের সামনের রাস্তা বন্ধ, কারণ একদল জার্মান রুশ দূতাবাসে ঢিল ছুড়ে ভাঙচুর করেছে। কাজেই উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও নানাবিধ সমীকরণের ভেতর দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছে। খাঁটি জার্মানদের পাশাপাশি পৃথিবীর বহু জায়গা থেকে যেহেতু এরইমধ্যে অনেক মানুষ এসে এখানে থিতু হয়েছে, তাই সংকটটি আর সরলরৈখিক নেই। কারণ অন্য দেশ ও জাতির মানুষ, যারা এখানে স্থায়ী নাগরিকত্ব নিয়েছে, তারাও নানাবিধ দাবি আদায়ে সোচ্চার। তার ভেতর দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা, আসন্ন নির্বাচন, সব মিলিয়ে নানামুখী সঙ্কটে এরা জর্জরিত।
ছবিটি দেখে বেরিয়ে এসে শপিং মল থেকে মনের জন্য একটা ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত টাইম মেশিন কারের ডাইকাস্ট কিনলাম। এসব কিনতে আমারও বেশ লাগে। আর ছোট্ট জেনোর জন্য কিনলাম সফট ডল সুপার মারিও। তারপর ধীর পায়ে বাসার দিকে। আজ আর স্ক্রিনিং নেই। বাসায় ফেরার পথে আরেকটি তুর্কি দোকানে ঢুকলাম। নিলাম বোরেক (Börek), এটি একধরনে লম্বা ক্রিমরোলের মতো জিনিস। তবে বেক করে বানানো খাবারটি নরম, আর ভেতরে নানাকিছু পুরে দেয়া হয়। কেউ মাংসের কিমা দেয়, কেউ দেয় সবজি, কেউবা আবার চিজ। আমি সবজির বোরেক কিনলাম। আমি যে বাসাতে থাকি, তার আগেপিছে প্রচুর তুর্কি রেস্তোরাঁ আর দোকান। আর দোকান ভর্তি তাদের খাবার। এমনকি জার্মান দোকানেও জায়গা করে নিয়েছে তুর্কি খাবারগুলো। তার মানে জার্মানরাও পছন্দ করছে তুর্কি হেঁসেলের রসায়ন। সারা বার্লিনেই দেখলাম অনেক খাবারের দোকান। স্বস্তা। দামী। গরীব মানুষেরা দুই-তিন ইউরোর খাবার কিনে নিয়ে খেতে খেতে চলে যাচ্ছে। অনেক অফিসগামী লোকও এসব চটজলদি খাবার কিনে নিয়ে খাচ্ছে। স্যান্ডুইচই মূলত। আর একটু বড় দোকানগুলোতে ভিড় জমে বিকালের পর থেকে। চলে পানীয় সহযোগে নৈশভোজ।
বাসায় ফিরে আমি খেতে খেতেই আমার কো-জুরি সারার ফোন। জানালো সে নাকি বরফে পা পিছলে আলুর দম! জামাকাপড় ভিজে একাকার। গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলের লন্ড্রিতে বসে কাপড় শুকাচ্ছে। বড় ধরনের কিছু হয়নি। শুভ কামনা জানিয়ে বললাম, হাত-পা ভাঙেনি, সেটাই বড় কথা। ছবি দেখতে থাকো। দেখা হবে।