আমার কাছে নচিকেতা সব সময়ই একটা মধ্যবিত্তের ক্ষ্যাপা গায়ক। লোকজন কবীর সুমন ও অঞ্জন দত্ত করতে করতে নচিকেতাকে মনে রাখতে চান না। অথচ নচিকেতা কোনো অংশেই এদের চেয়ে কম না। বরং পপুলারিস্ট ঘরানার দিকে থেকে থেকে নচিকেতা আরও বেশি গণমানুষের। নচিকেতা সব কিছুতেই আছেন, জীবনমুখী, আধুনিক, গজল, আধুনিক, মজা করা, প্রেমের গান, নীতি শিক্ষা, রাজনীতির গান, সিনেমার গান, আরও কত কিছুতে।
আমার কাছে নচিকেতা চক্রবর্তীর গান হলো শহুরে মধ্যবিত্তের চিন্তাভাবনার কণ্ঠস্বর। ধরেন সবার জীবনেই নীলাঞ্জনার মত প্রেম থাকে, মধ্যবিত্ত মানেই ডাক্তারদের দেখতে পারে না, মধ্যবিত্ত নিজে সরকারি কর্মকর্তা হতে চাইলেও তাদের অফিসে আরাম আয়েশ সহ্য করতে পারে না, বুঝে হোক না বুঝে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে তাদের আছে উন্নাসিকতা, মজার ছলে পুরুষ বিবাহিত হলে মৃত, বউয়ের কথা শোনা মানেই রেললাইনে বডি দেব মাথা দেব না, রাজনীতিতে নিজে না গিয়ে নিজের ছেলেকে মন্ত্রী বানানোর আশাবাদ, আবার লাভ স্টোরির সুর থেকে নিয়ে বিপ্লবী বন্ধুর জন্য দরদ সব পাবেন তার গানে। তার কিছু কিছু গান ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মতই নীতি শিক্ষার ফ্যাক্টরি, আর অনেক মধ্যবিত্তের মতই মেলোড্রামাটিক। এসব নিয়ে তিনি অনেক গর্ব করেন। যে তিনি সমাজে ম্যাসেজ দিতে দিতে সফল। আমার এই ‘মেসেঞ্জার’ নচিকেতা ভালো লাগে না। এমনিতেই সমাজের শরীর ম্যাজম্যাজ করে তার ভেতরে মেসেজের অত্যাচার আর প্রাণে সয় না। কিন্তু লোকজনের এই নচিকেতাকে ভালো লাগে, নচিকেতার একেকটা গানের যে হিট হালের অনুপমরাও এর ধারে কাছে নাই। ইউটিউবে তার কিছু গানের ভিউ বিস্ময়কর। এত জনপ্রিয়তা পেয়ে পেয়ে নচিকেতার ভেতরে একটা অহংকার আছে। এই অহংকারটা আমার ভালো লাগে না, উনি বলবেন, ‘আপনাদের তো আমাকে দরকার, নচিকেতা মানেই টিআরপি।’
আমার ভালো লাগে খ্যাপাটে এক মানুষ নচিকেতাকে। যিনি শো করে বেড়ান সমানে, ইচ্ছে মতো গাইতে থাকেন, গালাগাল করেন, আউটস্পোকেন থাকতেন সব সময়। সেই নচিকেতা হারিয়ে গেছেন হয়তো। যে নচিকেতা গাইতেন, ‘আমি তোমার জন্য কোনো কুমারের ধার করা গান গাইবো না’। কিংবা যিনি গাইতেন, ‘এ মন ব্যাকুল যখন তখন’। অথবা তারুণ্যের স্টেটমেন্ট, ‘আমি ভবঘুরে হবো এটাই আমার এম্বিশন’।
যুগ যন্ত্রণা তার গানে ছিল। বলেছেন, ‘ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে গ্রন্থকীটের দল বানায় নির্বোধ’, ‘উল্টো রাজার উল্টো দেশের কথা’, ‘অসৎ হবার বহু প্রচেষ্টায় ব্যর্থ করেছি নিজেকে’। যিনি সাবেক প্রেমিকার উদ্দেশ্যে গান গাইতে পারেন, ‘এখন সোনার খাঁচায় খেলনা পাখি সেজে রাত্রিদিন সুতোয় নাচা’। সবার প্রিয় গান ‘উই শেল ওভার কাম’কে তিনি আমাদের জন্য বানিয়েছেন, ‘এক বোকা বুড়োর গল্প শুনো’। তারপর যে জিনিসটা কেউ বলে না নচিকেতা অত্যন্ত ভালো কিছু প্রেমের গেয়েছেন আমাদের জন্য। তিনি যতই হুমকি দিতে থাকেন না কেন, ‘মেয়ে তুমি কি আমায় ভালোবাসো?’ আসলে তার অন্তরের কথা হলো, ‘আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে’ একই পথে দেখা হবার আকুতি। তিনি গেয়েছেন, ‘তুমি আসবে বলে আমার কলম এখনও বিক্রি হয়নি’! ‘পৌলমী’ ‘পেসমেকার’, ‘পাগলা জগাই,-এর মতো সব গান। সিনেমায় তিনি আমাদের জন্য গেয়েছেন, ‘একদিন স্বপ্নের দিন’, কিংবা ‘কে আছো কোথায়’-এর মতো দুর্দান্ত গান। হঠাৎ বৃষ্টি সিনেমায় তার গাইবার কথাই ছিল না। কিন্তু তিনি বললেন, ‘তিনি না গাইলে এ গানগুলোর এখানেই ইতি’। এরকম ইগোর সাগরে ভাসা নচিকেতাই আমার প্রিয়। যখন ইন্ডাস্ট্রি ছিল তিনি অনেক মিক্সড ক্যাসেট করতেন। শুভমিতা থেকে ঢাকার প্রীতম সবার সঙ্গেই তার অ্যালবাম আছে। ছোটবেলায় বড়দের আড্ডায় দেখতাম দল বেঁধে নচিকেতার গান গাইতে। সবাই যেন নচিকেতার গানের মতোই, ‘আমার স্বপ্ন কিনতে হলে আস্ত পাগল হওয়া চাই।’ এই পাগলামি হয়তো এখনকার নচিকেতার ভেতরে পাবেন না।
অথচ নচিকেতা কিন্তু মোটিভেশন স্পিকারদের চেয়েও হার না মানা লোক। তিনি প্রচুর স্ট্রাগল করেছেন। কিন্তু তাকে দেখবেন স্ট্রাগলের গল্প খুব একটা করবে না। তিনি বলবেন, ‘আমি যতদিন ইন্ডাস্ট্রি ছিলাম, আমি তরুণ শিল্পীদের সব সময় সাহায্য করেছি, যা আমি নিজে পাইনি।’ ১১ বছর লেগেছে তার ব্রেক পেতে। কত কিছু করেছেন সে জীবনে। সাংবাদিক, হকার, ইনস্যুরেন্সের দালাল, মিউজিসিয়ান, সেলসম্যান, বেশির ভাগ সময় বেকার ভবঘুরে। উনি বলেছেন, ‘আমার জীবন ছিল অন্যের খুশির কারণ।’ মায়ের ছিল ক্যানসার। কিছুই ছিল না তার পক্ষে। সেখান থেকে তিনি পশ্চিম বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল শিল্পী। নচিকেতার যে গল্পটা কেউ জানে না সেটা হলো, নচিকেতা দারুণ সেমি ক্লাসিকাল জানেন। তার গজল অনবদ্য। বম্বেতে তাকে ডাকতো, তিনি যেতে চাননি। কবীর সুমন আর নচিকেতা আগে খুব পরস্পরের কাছে ছিলেন। আমার আজো মনে পড়ে সুমন যখন ইলেকশন করেন, নচিকেতা গান গেয়ে গেয়ে ক্যানভাস করেছিলেন। তার মতো আসর জমাতে পারে এমন শিল্পী আজো কম। কবীর সুমন ভূয়সী প্রশংসা করতেন নচিকেতার। বলতেন, ‘শুধু গান না গেয়ে হারমোনিয়াম বাজালেই নচিকেতা ভারতের বিখ্যাত হতেন, এত ভালো হারমোনিয়াম কাউকেই দেখেননি বাজাতে।’ অঞ্জন দত্তও নচিকেতাকে খুব ভালোবাসতেন আগে। অঞ্জন দত্তের একেকটা সিনেমা মানেই নচিকেতার গান। সেই সময় এখন নেই। তবে নচিকেতার একটা কথা আমার প্রিয়, ‘ওমুককে ধরো, তমুককে বলো এসব করে যারা শিল্পী হয় তাদের পক্ষে নচিকেতা হওয়া সম্ভব না।’ নচিকেতা মানেই একটা সময় আমাদের কাছে ছিল আপসহীনতা। যিনি গানে গানে বলে গেছেন, ‘তোমার ভাবনা সূর্য হয়ে ডুববে যে সন্ধ্যায়।’
এত কথা বলার কারণ, আজ নচিকেতার জন্মদিন। থাকুক পড়ে এইসব ভালোবাসাটুকুই!