উৎসবের সূর্য মধ্যগগন অতিক্রম করছে। এর ভেতর বৈঠক, দেখাসাক্ষাৎ ও ছবি দেখা চলছে। পঞ্চম দিন দুপুর নাগাদ দেখা করতে হলো জার্মান বন্ধু, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক এক্সেল টিমো পারের সাথে। ও অনেকদিন ধরেই বলছিল একসাথে বসে চা খাবে। রাজনীতিমনস্ক এক্সেল বাংলাদেশের খোঁজখবর কিছুটা রাখলেও আমার কাছ থেকে পুরো প্রেক্ষাপট বুঝতে চায়। যা বুঝিয়ে বললাম,তার মর্মার্থ হলো, আমরা খোলা থেকে আগুনে, আগুন থেকে খোলায়, এই খেলার ভেতর পড়ে গেছি। এরপর সিনেমা নিয়ে আলাপ হলো। জিজ্ঞেস করল, একটাও জার্মান ছবি দেখেছি কি না। বললাম, ‘পাঞ্চিং দ্য ওয়ার্ল্ডে’র নাম।
এক্সেল বলল, ওর ছবিটা ভালো লেগেছে। বললাম, আমারও ভালো লেগেছে। কেন লেগেছে? কারণ ছবিটি রূপকের ভেতর দিয়ে জার্মানির রাজনীতির কথা বলেছে। বিশেষ করে দুই ভাইয়ের ভেতর মাধ্যমে। এক ভাই পশ্চিমে চলে যায়, আরেকজন পূর্বে রয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত গৃহদাহ দেখতে থাকে। দুই ভাই আসলে পূর্ব ও পশ্চিমের মেটাফোর। এক্সেল আশ্চর্য হয়ে বলল, আরে এভাবে তো ভাবিনি! খুবই ইন্টারেস্টিং রিডিং তোমার।
বেলা তিনটায় বার্লিনাল পালাস্তে রয়েছে চীনা ছবি ‘গার্লস অন ওয়াইয়ার’ (২০২৫), পরিচালক ভিভিয়ান কু। এক্সেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন পালাস্তের দিকে যাচ্ছি, রেড কার্পটের পাশ দিয়ে, তখন এই ছবির উত্তাপ গায়ে এসে লাগল। বুঝলাম চীনা বড় তারকা এই ছবিতে অভিনয় করেছেন। কারণ প্রচুর চীনা দর্শক চিৎকার আর উল্লাস করে অভিনয়শিল্পীদের রেডকার্পেটে অভিবাদন জানাচ্ছে। আর হুমড়ি খেয়ে খাতা কলম বাড়িয়ে দিচ্ছে, অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য। ওদিকে নিরাপত্তাকর্মীরা বলছে, আপনারা ভেতরে যান, এখানে ভিড় করবেন না। কে শোনে কার কথা! আমি ধীর পায়ে তারকা আর ভক্তদের দেখতে দেখতে বিশাল পালাস্তের তিন তলায় উঠলাম। নির্ধারিত আসনে বসার পর তারকারা এলেন। তারপর শুরু হলো ছবি।
দুই বোনের গল্প। তিয়ান তিয়ান আর ফ্যাং ডি। মামাতো-ফুপাতো বোন তারা। তাদের পরিবার ও পারিবারিক ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর দুই বোন আলাদা হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে ছোট বোন ফ্যাং ডি বন্দী হয় মাদক চোরাচালান চক্রের কাছে। সেখানে একটি খুন করে ফ্যাং ডি পালিয়ে আশ্রয় নেয় বোন তিয়ানের কাছে। তিয়ান চলচ্চিত্রে স্টান্টম্যান বা ডাবলের কাজ করে। অর্থাৎ অ্যাকশন দৃশ্যগুলো নায়িকার হয়ে সে করে দেয়। ফ্যাং ডিকে খুঁজতে খুঁজতে দুষ্টু লোকেরা তিয়ানের সন্ধান পেয়ে যায়। তারপর শুরু হয় তাদের পলায়ন ও পাল্টা লড়াই। ছবির শেষে দুষ্টুরা সাজা পায় আর শেষ দৃশ্যে দেখা যায় তিয়ান স্টান্ট দৃশ্যে উঁচু ভবন থেকে পড়ে গিয়েও পাখা মেলে আবার উড়ে যাচ্ছে। মানে কোনো ফ্যান্টাসি মার্শাল আর্ট মুভির দৃশ্য আর কি। তো সব মিলিয়ে ছবিটি নারীর লড়াই ও শেষ পর্যন্ত আকাশে ডানা মেলে স্বাধীনভাবে ওড়ার কথা বলে। অ্যাকশন-থ্রিলার ধাঁচের ছবিটি বার্লিনালের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে রয়েছে। আমার কেন যেন কম্পিটিশন সেকশনের চেয়ে পার্সপেক্টিভস সেকশনের ছবিগুলোই ভালো লাগছে। ভাগ্যিস কম্পিটিশন সেকশনের সব ছবি বাধ্যতামূলকভাবে দেখতে হচ্ছে না। যে দুটো দেখলাম দুটোই বাজারি উপাদান মেশানো কিছুটা হাল্কা মেজাজের ছবি।
যাহোক, পরের ছবিটি রাত সোয়া নয়টায় সিনেম্যাক্সের নয় নম্বর হলে। মাঝে অনেকটা সময়। এরই ফাঁকে আমার সাথে পরিচয় হলো এক ইতালিয়ান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের সাথে। আমার কো-জুরি ইতালিবাসী সারা পরিচয় করিয়ে দিলেন। তো ওই সাংবাদিক কথায় কথায় বলছিলেন তিনি ফিল্ম ক্রিটিকদের সংগঠন ফিপ্রেসির সদস্য নন। কারণ তিনি মূলত ফিল্ম রিভিউ লিখেন এবং বিনোদন সাংবাদিকতা করেন। আমি শুনি আর হাসি। কারণ, মনে মনে ভাবছিলাম, বাংলাদেশে বিনোদনের সংবাদ লিখে আর দুচারটা ফিল্ম রিভিউ লিখে লোকজন নিজেদের ফিল্ম ক্রিটিক বলে। ফিল্ম ক্রিটিক হতে গেলে লেখার ভেতর যে ক্রিটিকাল থিংকিং থাকতে হয়, অর্থাৎ এনালাইজ ও রিজনিংয়ের ভেতর দিয়ে একটি লেখাকে উপস্থাপন করতে হয়, সেই বোধটাই নেই। লেখাতে যে থিয়োরিটিকাল এপ্রোচ থাকতে হয়, নতুন দৃষ্টিকোণ পাওয়ার জন্য, সেসব কথা কে কাকে শেখাবে? আমাদের দেশে বিজ্ঞাপনচিত্র বানিয়ে যেমন লোকজন নিজেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা দাবি করে, তেমনি ফিল্ম রিভিউ ও বিনোদন সাংবাদিকতা করে লোকে নিজেকে বলে ফিল্ম ক্রিটিক।
এসব নিয়ে বলে কোনো লাভ নেই, বরং চলুন পরবর্তী ছবি ‘হি মান’ বা ‘এল’ (২০২৫) নিয়ে কথা বলি। তাইওয়ানের ছবিটির পরিচালক চু চুং-ট্যান। ডেব্যু ফিল্মে তিনি পরিবেশ নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু খুবই ভিন্নভাবে, নারীপুরুষের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে। তাইপেইয়ের এক প্রান্তে, ময়লা ও দূষণে মৃতপ্রায় নদীর পারে, ভাঙাচোরা ঘরে একটি ছেলে থাকে, সে ময়লা সরানো ও গার্বেজ রিসাইকেল করার প্লান্টে কাজ করে। একদিন ঘন সবুজ প্রকৃতি থেকে লাল পোশাক পরা এক তরুণী ভাসতে ভাসতে এসে চলে আসে ছেলেটির ঘরের কাছে। ছেলেটি ঘনিষ্ঠ হয় মেয়েটির। মেয়েটি জানে না সে কোথা থেকে এসেছে, আর কি তার পরিচয়। অদ্ভুত তার আচরণ। ছেলেটির সঙ্গে যখন সে মিলিত হয় তখন সে ফাঁস পরিয়ে দেয় ছেলেটির গলায়। ছেলেটি সেই ফাঁস লাগা অবস্থাতেই প্রবেশ করতে থাকে মেয়েটির ভেতর। কিতাবি পরিভাষায় একে বিডিএসএম (বন্ডেজ, ডিসিপ্লিন, স্যাডিজম, ম্যাসোকিজম) বলে। নরনারীর রসায়নটা এখানে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যেন দর্শক ভালোবাসা ও ঘৃণার যুগপত অনুভূতি বহনকারী কোনো কবিতার লাইন পড়ছেন।
অনেকেরই হয়তো ধীর গতি, রূপক ও যৌনতানির্ভর ছবিটিকে ভালো লাগবে না। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায় ছবিটি প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে নির্মিত। ভাষা ও দর্শন যাদের কিঞ্চিত জানা রয়েছে, তারা ধরতে পারবেন, মেয়েটি প্রকৃতি থেকে এসেছে, প্রকৃতির রূপক হয়ে, নারী মানেই প্রকৃতি, প্রকৃতি মানেই নারী। আর পুরুষ মানে পুরের উপর ঊষের উদয়। ঊষের ভাবগত আভিধানিক অর্থে কিন্তু পীড়ন করাকেও বোঝায়। তো পুরুষ, এই সিনেমায়, আমার কাছে মানবজাতি। যা প্রকৃতির উপর পীড়ন চালাচ্ছে। প্রকৃতির সাথে সে মিলিত হচ্ছে কিন্তু সেই মিলনে সুখ নেই। যন্ত্রণা আছে। কিন্তু মিলনব্যতীত সে নিজেও বাঁচবে না। ছবির এক সংলাপে যখন ছেলেটি ঝড়বৃষ্টিতে কবুতরের ঘরটি ভেঙে গেলে ঠিক করতে যেতে চায়, তখন মেয়েটি বলে, থাক আর ওটা ঠিক করতে যাওয়ার দরকার নেই। তখন মনে হয়, প্রকৃতি বলছে মানবজাতিকে, দুনিয়াকে ঠিক করতে গিয়ে তুমি যথেষ্ট ক্ষতি করেছো প্রকৃতির। আর না, এবার থামো।
চলচ্চিত্রটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্ধৃতি দিয়ে। মানুষের অস্তিত্ব ও দুনিয়াকে দেখা সম্পর্কিত উদ্ধৃতি। ইংরেজিতে লেখা উদ্ধৃতির মূল বাংলাটা খুঁজে দেখতে হবে। আরো একটি ছবিতে উদ্ধৃতির ব্যবহার দেখেছি এই উৎসবে। অস্ট্রিয়ার ছবি ‘হাউ টু বি নরমাল অ্যান্ড দ্য অডনেস অব দি আদার ওয়ার্ল্ড’ শুরুই হয় আন্তোনিও গ্রামশির একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে: “The old world is dying, and the new world struggles to be born: now is the time of monsters.” আর একারণেই ছবির চরিত্র পিয়া নিজের কল্পনায় দানবের আবির্ভাব দেখে। আগের অধ্যায়ে এই ছবিটা নিয়ে বিষদ আলাপ করেছি। গ্রামশির এই উদ্ধৃতিটি কিন্তু ভয়ংকর এক সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ বলি, আর জার্মানি, গোটা দুনিয়া এখন যে ভাবনার দ্বারা তাড়িত হচ্ছে, বা যারা তাড়া দিচ্ছে অনবরত, সেই ভাবনা এরই ভেতর মারা গেছে। কিন্তু নতুন কোনো ভাবনার দেখাও মিলছে না। ধরুন সমাজতন্ত্র খারাপটারাপ বলে ওটাকে তাড়িয়ে দিয়ে, যে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হলো, সেটার ফল তো যুদ্ধ ও মানুষের হয়রানির ভেতর দিয়ে ফুটে উঠছে। তাহলে মুক্তি কোন পথে?
সেই মুক্তির পথ সন্ধানে শিল্পসাহিত্য, চলচ্চিত্র আমাদের সহায়তা করে। কারণ এগুলো আপনাকে, আমাকে ভাবিয়ে তোলে। নতুন নতুন ভাবনার খোড়াক জোগায়, পাশাপাশি পুরোনো অচল ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেলতে সাহায্য করে। একারণে পাঠাগার দরকার, একারণে সিনেমাগার দরকার। চিন্তার অনুশীলনের জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। একারণেই ফরাসি দার্শনিক আলাঁ বাদিয়ু বলেন, আধুনিক প্রেক্ষাগৃহই হলো প্লেটোর সেই গুহা, সেখানে ফিরে চলো। ওখানেই হয় তো মানুষ খুঁজে পাবে জীবনের অভিনব মানে।