জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মনি কিশোর মারা গেছেন। শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর রামপুরার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নব্বই দশকের তুমুল জনপ্রিয় এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোকের মাতম চলছে সংগীতাঙ্গনে।
জনপ্রিয় এই শিল্পীর আসল নাম অনিল কুমার মন্ডল। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল শিল্পী হবেন। পড়াশোনার ফাঁকে এদিকটায় ছিল তার তীব্র আগ্রহ। বাবার চাকরিসূত্রে যশোর, ফরিদপুর, নড়াইল হয়ে একটা সময় গানের টানে ঢাকায় বড় বোনের বাসায় এসে থিতু হন। এই বোনের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা না থাকলে মনি কিশোর নামের কাউকে চিনত না দেশের মানুষ। বড় বোনের উৎসাহে তিনি গান নিয়মিত করেন। আর একটা সময় গীতিকার-সুরকার ও সংগীত পরিচালক মিল্টন খন্দকারের মাধ্যমে বিটিভি তার প্রতিভাকে বিকাশের বড় সুযোগ করে দেয়।
সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিটিভিতে গাইলেন ‘কী ছিলে আমার’, এই গান প্রচারের পর দেশের আনাচকানাচ থেকে অনেক চিঠি পেয়েছেন। জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পী পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। রেডিও-টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হলেও গান গেয়েছেন অল্প। মূলত অডিওতে চুটিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তারই সুর করা ও লেখা। মাঝে দীর্ঘদিন নতুন গান প্রকাশ থেকে দূরে ছিলেন এই গায়ক।
চলতি বছর এক সাক্ষাৎকারে এই শিল্পী জানান, তিনি আবারও গান করছেন। জানিয়েছিলেন, পুরোনো গানগুলো ইউটিউবে দিচ্ছেন পর্যায়ক্রমে। জনপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ নতুন করে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁ ভাষ্য ছিল, এ প্রজন্মের শ্রোতারা গানটি শুনেছেন।
ইউটিউবে প্রচুর ভিউ। স্টেজে গেয়ে থাকেন তরুণেরা; কিন্তু গানের মূল গায়ককে তাঁরা চেনেন না। গানটির সুরকার ও গীতিকার কে, তা জানেন না। এ রকম জায়গা থেকে ভেবেছেন, এ প্রজন্মের কাছেও গানটি পরিচিত হোক। তাঁদের মধ্যে এটি ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এ ছাড়া আলাদা করে দেড় শ গান তৈরি করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গানগুলো আমার জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে চাই না। কিছু গান মৃত্যুর পরও প্রকাশ পাবে।’ জীবদ্দশায় মনি কিশোর তাঁর এই গানগুলো প্রকাশের আগেই চলে গেলেন অনন্তযাত্রায়। এই শিল্পী যেমনটি চেয়েছিলেন, হয়তো সেই ইচ্ছা পূরণ করবে তাঁর পরিবার। তাঁর তৈরি হওয়া গানগুলো হয়তো সামনে প্রকাশিত হবে।
শিল্পী হওয়ার তাড়নায় ঢাকায় এসে উঠেছিলেন বড় বোনের বাসায়। দুলাভাই নাকি গান গাওয়ার বিষয়টি পছন্দ করতেন না। তাই দুলাভাইয়ের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতেন। সেই ঘটনার বর্ণনা মনি কিশোর দিয়েছিলেন এভাবে, ‘ঢাকায় বোনের বাসায় পাম্পের বালিশ ফুলিয়ে ফুলিয়ে ঘুমাতাম। বড় বোন মায়ের মতো ছিলেন। তার কারণে আমার মনি কিশোর হয়ে ওঠা।
আরেকটা কথা, দুলাভাই বাসায় থাকা অবস্থায় রুমে ঢুকতাম না, বিরক্তি বোধ করবেন ভেবে। তিনি যখন বাসায় থাকতেন, আমি বাসার সানশেডে ঘুমাতাম। এরপর বাসা থেকে চলে গেলে ঘরে এসে ঘুমাতাম। ওর বাসায় সেই আশ্রয়টুকু না পেলে মনি কিশোর হতে পারতাম না। হয়তো সেই মন্ডল বংশে ফিরে যাওয়া লাগত।’
নব্বইয়ের দশক থেকেই গান গেয়ে শ্রোতার মন মাতিয়েছেন মনি কিশোর। সেই কবে গেয়েছিলেন ‘কী ছিলে আমার, বলো না তুমি’; তা আজও অনেক সংগীতপ্রেমী গেয়ে ওঠেন আপন মনে। সেই গানের স্রষ্টা মনি কিশোর দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। অনেকটা অভিমান থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। শেষ দিকে তো এমনও হয়েছে, কেউ যাতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে, নিজের ব্যবহৃত পুরোনো মুঠোফোন নম্বর বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
এ দেশে মনি কিশোর আর জন্মাবে না বলেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যক্তি মনি কিশোর আর গায়ক মনি কিশোরের আকাশ–পাতাল তফাত। কোনো মিল নেই। চরিত্রের মিল নেই, কথাবার্তার মিল নেই, চালচলনের মিল নেই। মানুষ মনি কিশোর যখন মাইক্রোফোন হাতে নেয়, তখন সে অন্য এক মনি কিশোর হয়ে ওঠে। অসাধারণ গায় সেই মনি কিশোর। আমি শ্রোতা হিসেবে শিল্পী মনি কিশোরের গান দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শুনেছি। শ্রোতা হিসেবে বলছি, শিল্পী মনি কিশোর জন্মাবে না আর।’