• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঢাকাই সিনেমায় ফিরছে সোনালি যুগ?


সামিয়া বিন্দু
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৩, ০৭:৩৬ পিএম
ঢাকাই সিনেমায় ফিরছে সোনালি যুগ?

দীর্ঘ দুই যুগ ধরে খরা চলছিল বাংলাদেশের সিনেমায়। কোনোভাবেই দর্শক টানতে পারছিল না ঢাকাই ছবি। ফলে একের পর এক হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। একটা সময় যেখানে বাংলাদেশে ১২০০ এর মতো সিনেমা হল ছিল, তা কমতে কমতে এসে দাঁড়ায় একশতে। অবস্থা এমন হয়েছে, শুধু দুই ঈদ ঘিরে এখন মুক্তি পায় বাংলাদেশের সিনেমা। তার সংখ্যাও খুব বেশি না।

এর মধ্যে ২০১৯ সালের শেষের দিকে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আঘাত হানে করোনা মহামারি। স্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু। স্থবির হয়ে পড়ে সিনেপাড়াও। এভাবে কাটে আরও দুই বছর। তবে কারোনাকাল কাটার সঙ্গে সঙ্গে যেন কাটতে থাকে বাংলাদেশের সিনেমার খরাও। ২০২২ সালে হাওয়া লাগে দেশীয় সিনেমার পালে। ভালো ছবির আশ্বাসে দর্শকও ফিরতে শুরু করেন হলে।

মূলত মেজবাউল হক সুমনের ‘হাওয়া’ সিনেমা দিয়ে দিন বদল শুরু হয় বাংলাদেশের সিনেমার। এর কিছু পরে আসে কোরবানির ঈদ। এই ঈদে মুক্তি পায় ‘পরাণ’, ‘দামাল’ ও ‍‍`অপারেশন সুন্দরবন‍‍`ও। প্রত্যেকটি সিনেমাই কম বেশি হলে দর্শক টানতে পেরেছিল। তবে ওই বছর সবচেয়ে আলোচিত ছিল হাওয়া সিনেমাটিই। যেটি পরবর্তী সময়ে কলকাতায়ও সাড়া জাগায়।

দর্শকদের আগ্রহ দেখে সিনেমা বানাতে উৎসাহিত হন পরিচালক ও প্রযোজকরা। ইন্ডাস্ট্রি পাচ্ছে একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা। শুধু চলতি বছরের কথা বললেও তার এক ঝলক বোঝা যাবে। এ বছর দুই ঈদকে ঘিরেই সিনেপাড়া ছিল সরগরম। হল যেমন দর্শকে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল, তেমনি রেকর্ড সংখ্যক সিনেমাও মুক্তি পেয়েছে এবার।

এ বছর মুক্তি পাওয়া ১৮টি ছবির মধ্যে আছে, ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’, ‘লোকাল’, ‘জ্বীন’, ‘শত্রু’, ‘আদম’, ‘কিল হিম’, ‘পাপ’, ‘প্রেম প্রীতির বন্ধন’, ‘আদিম’, ‘মা’, ‘সুলতানপুর’, ‘আমি টোকাই’, ‘যেমন জামাই তেমন বউ’, ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘প্রহেলিকা’, ‘লাল শাড়ি’, ‘ক্যাসিনো’। এ ছাড়াও প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ভারতের ‘পাঠান’ সিনেমাসহ বলিউডের বেশকিছু সিনেমা। দেশীয় এসব ছবিতে চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় তারকা শাকিব খান যেমন ছিলেন, তেমনি পাঠান দিয়ে দেশের প্রেক্ষাগৃহে দেখা দেন বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানও। দেশের তারকাদের মধ্যে অপু বিশ্বাস, অনন্ত জলিল, পরীমনি, বর্ষা, পূজা চেরি, শবনম বুবলী, আফরান নিশো, তমা মির্জা, মাহফুজ আহমেদ, নিরব, সাইমন সাদিক, সজল, আদর আজাদ, সাঞ্জু জন প্রমুখ তারকাও ছিলেন।

এবারের ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ এবং আফরান নিশো অভিনীত ‘সুড়ঙ্গ’। সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হলগুলোতে এ দুটি ছবি দেখতে ঢল নামে দর্শকদের।

এরমধ্যে ‘প্রিয়তমা’ দেশে-বিদেশে রেকর্ড সংখ্যক ব্যবসা করেছে। এমনও হয়েছে দেশের হলগুলোতে দর্শক টিকিট না পেয়ে ফিরে গেছেন। ভক্তরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছেন বড় পর্দায় শাকিবকে এক ঝলক দেখবে বলে। কেউ কেউ অভিনয় দেখে কান্না করেছেন, কেউ আবার শাকিবের নতুন লুক দেখে মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন। শাকিবের সিনেমা বিদেশেও প্রায় এক কোটি টাকার ব্যবসা করেছে বলে জানা গেছে। দেশের ১০৮টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল শাকিবের ‘প্রিয়তমা’। এই সিনেমার বিশেষ চমক ছিলেন ভারতীয় অভিনেত্রী ইধিকা পাল। তার অভিনয়ও প্রশংসিত হয়। শাকিবের বিপরীতে ভিন্ন মুখকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ভক্তরা।  

এসবই বলে দিচ্ছে সিনেমা যেন ফিরে পাচ্ছে তার আগের জৌলুস। কয়েক মাসের ব্যবধানে ২০টিরও বেশি সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা। নতুন করে আশা জাগছে প্রেক্ষাগৃহমালিকদেরও। এমনকি দর্শকরাও সিনেমার এমন জোয়ারকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।

শুধু ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমা চললেই কি সিনেমার সুদিন ফিরেছে বলা যাবে? এ বছর দেশি ও বিদেশি উভয় ধরণের সিনেমাই মুক্তি পেয়েছে। তবে বিদেশি সিনেমার থেকে দেশি সিনেমার দর্শকপ্রিয়তা ছিল বেশি। সিনে-অঙ্গনে এমন চিত্র চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা কীভাবে দেখছেন তা জানতে সংবাদ প্রকাশ কথা বলে কয়েকজনের সঙ্গে।

‘দামাল’ ও ‘পরাণ’ সিনেমা দিয়ে বেশ আলোচিত হন অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মীম। প্রেক্ষাগৃহে সিনেমার সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, “একের পর এক ভালো সিনেমা আসছে। এটা খুবই ভালো আমাদের জন্য। তবে আমরা শুধু ঈদের সময়টায় বেশি গুরুত্ব দেই। সেটা না করে আমরা যদি প্রত্যেক মাসে এ রকম ভালো ছবি উপহার পাই তবে সেটা আরও বেশি ভালো হবে।”

এ নিয়ে ‘হাওয়া’ সিনেমাখ্যাত নাজিফা তুশি বলেন, “এখন অনেক সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, সেটা অবশ্যই আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য ভালো। এখন কোয়ান্টিটি বাড়ছে। সেটা সিনেমা হলে হোক কিংবা ওটিটিতে। এটার কারণে আমাদের কাজেরও পরিমাণ বাড়ছে। আমার মনে হয়, এই সময়টা খুবই ভালো আমাদের আর্টিস্টের জন্য ও ডিরেক্টর, রাইটার সবার জন্য। যেটা আরও আগে হওয়া উচিৎ ছিল। তবে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সেটা সবার জন্য ভালো।”

সিনেমার এক সময়ের বিখ্যাত খলনায়ক ডিপজল। তিনি বললেন, “অবশ্যই ভালো লাগছে, ভালো চলছে সিনেমা। এটা আশা করি যেন সব ছবি ভালো চলে। দর্শকরা দেখলে আমরা আগাতে পারব। সিনেমা যেমনই হোক দর্শকরা দেখছে। আমি আশা করি সিনেমাগুলো যেন সবাই হলে এসে দেখে। আমাদের আগ্রহটা আরও বাড়বে।”

এ সময়ের অভিনেতা আরেফিন শুভ বলেন, “এটা খুবই আশার একটি বিষয়। আমাদের দর্শকরা আমাদের কাজ দেখতে চায়, হয়তো আমরাই কোথাও না কোথাও ব্যর্থ হয়েছি তাদের সেটা দিতে। তবে এখন দর্শকও হলে ফিরছে। এটাতো ভালো বিষয়। আমরা এখন নতুন সময়ে যারা কাজ করছি নতুনভাবে গল্পগুলো উপস্থাপন করছি। এখনকার মতো করে উপস্থাপনা করছি এতে দর্শকও দেখছে।”                            
দর্শক হলমুখী হওয়ায় হল মালিকদের পাশাপাশি অভিনয়শিল্পীরাও ইতিবাচক মনোভাব রাখছেন। ডিপজল বলেন, “হলে যত দর্শক যাবে আমরাও হল বানাব। আমারই তিনটা সিনেমা হল বন্ধ করে দিয়েছিলাম, এখন আবার চিন্তাভাবনা করছি পাঁচ-দশটা সিনেমা হল করব।”

সিনেমা অঙ্গনে অনেক নতুন সম্ভাবনা দেখছেন অভিনয়শিল্পীরা। নাজিফা তুশি বলেন, “আশেপাশের প্রোডাকশন হাউজে আমার বন্ধুরা, কলিগ সবাই সিনেমা করছে বা ওটিটিতে কাজ করছে। এখন যে সবাই সিনেমা বা সিরিজ করতে চায়, পাঁচ বছর আগে আমরা এই কথাটাই শুনতাম না। এখন কাজের মান বৃদ্ধি পেয়েছে, সবাই আগ্রহী এটা আমাদের জন্য ভালো। বিদেশি সিনেমাও যে আসছে ও চলছে। এই যে সিনেমার আদান-প্রদান ও অডিয়েন্স যে রুচি ছিল কাজ দেখছে ও বিনোদন নিচ্ছে এটা আমার মনে হয় ব্যবসায়িকভাবে আমাদের এগিয়ে রাখবে।”

সনি সিনেমা হল মালিক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, “২০২৩ সাল আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য আশীর্বাদ। যে সিনেমা হল ও সিনেমা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তা থেকে আমরা উত্তরণের উপায় খুঁজে পেয়েছি। হলে আবার দর্শক আসা শুরু করেছে। এতে আমরা চলচ্চিত্রবাসী গর্বিত ও আনন্দিত। শুধু বাংলাদেশে নয় বহির্বিশ্বেও আমাদের সিনেমা চলছে। বিদেশিরাও আমাদের সিনেমা দেখছে। এর থেকে বেশি আমরা কীভাবে আনন্দিত হতে পারি!”

সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানো পাল্টে যাবে চলচ্চিত্রের মান—এমন ধারণা চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের। এ ধারা অব্যাহত থাকবে, নাকি হঠাৎ করে আবার থমকে যাবে তা সময়ই বলে দেবে। 

Link copied!