বলিউডের ব্যতিক্রমী ও শক্তিমান অভিনেতা ইরফান খানের চলে যাওয়ার তিন বছর পূর্ণ হলো আজ (২৯ এপ্রিল)। কিন্তু এখনো তার সহ-অভিনয়শিল্পী, পরিচালক ও স্বজনরা ভুলতে পারেননি এই মানুষকে। সবার স্মৃতিজুড়ে ভীষণ জীবন্ত ইরফান খান। ইন্ডাস্ট্রির অনেকে অবাক হয়ে ইরফানের অন্য ধারা এবং মূলস্রোতের ছবিতে একই সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার বিস্ময়কর দক্ষতার কথা মনে করেন।
‘পিকু’ সিনেমার পরিচালক সুজিত সরকার তার স্মৃতিচারণা করলেন এভাবে—ইরফান আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এখনো ভীষণভাবে বেঁচে আছেন। আমি ওকে ভীষণভাবে মিস করি। তবুও মনে হয় আমি ওর পাশেই বসে আছি। কথা বলছি দুজন। এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে আমরা কথা বলিনি। আধ্যাত্মিকতা, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতিষবিদ্যা, দর্শন সবই ছিল আমাদের আলাপের বিষয়। মুম্বাইয়ে আমার অফিসে কত দিন ইরফান ঢুকে বলেছে, চলো ঝালমুড়ি আর চা খেতে খেতে গল্প করি। তিনি এমন একজন অভিনেতা ছিলেন, যার সঙ্গে বক্স অফিস ছাড়া, সিনেমা ছাড়া, বড় কোনো প্রজেক্টের পরিকল্পনা ছাড়াও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে কথা বলা যেত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি আরও যেসব অভিনেতার সঙ্গে কাজ করি, তারাও কেন ইরফানের মতো হয় না?
এ নির্মাতা আরও বলেন, “২০২১ সালে আমি ‘সরদার উধম’ নামে বিপ্লবী উধম সিংয়ের জীবন নিয়ে যে ছবিটা করেছিলাম, তাতেই প্রধান ভূমিকায় ইরফানের অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য তা সম্ভব হয়নি।”
সুজিত সরকারের মতো তিগমাংশু ধুলিয়া ইরফান খানকে নিয়ে ২০০৩ সালে পরিচালনা করেছিলেন ‘হাসিল’ এবং ২০১২ সালে আত্মজীবনীমূলক ‘পান সিং তোমর’ ২০১৩ সালে ‘সাহেব বিবি অউর গ্যাংস্টার রিটার্নস’-এর মতো সিনেমাগুলো।
তিগমাংশু ধুলিয়া ইরফানের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমি যখনই কোনো ছবি করার কথা পরিকল্পনা করি প্রথমেই আমার মাথায় আসে ইরফান খানের নাম। ইরফান খান আমাকে পরিচালক হিসেবে পরিণত হতে অনেক সাহায্য করেছেন। তার চলে যাওয়া পরিচালক হিসেবে আমার ছবি তৈরি করার গতি যেন শ্লথ করে দিয়েছে।”
ইরফানের অসময়ে চলে যাওয়ায় তার দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার সহপাঠী, পরে সহধর্মিণী হওয়া বঙ্গকন্যা সুতপা সিকদারকে স্থবির করে দিয়েছে। ইরফান চলে যাওয়ার পর সুতপা দু-একটি জায়গা ছাড়া তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে খুব বেশি কথা বলেননি। যেন একান্তেই ইরফানের স্মৃতিকে তিনি নীরবে বয়ে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু বাবার তৃতীয় প্রয়াণদিবসে সদ্য অভিনয়ে আসা ইরফানের বড় ছেলে বাবিল খান স্মরণ করেছেন বাবাকে। বাবিল বলেন, “একবার আমি আর বাবা আমাদের ফার্ম হাউস লগতপুরীতে গিয়েছিলাম। এর গা ঘেঁষে একটি নদী আছে। নদীতে নামার সময় বাবা আমাকে বললেন সাঁতারের পোশাক পরে নাও। আমি একসময় নদীর জলে চিৎ হয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে হাত-পা ছড়িয়ে এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। বাবা আমাকে নদীর জল থেকে উঠে আসতে বললেন। পরে বলেন, তুমি আবার এটা পরের দিন করো। এভাবে আমি পরপর ৯ দিন নদীর জলে নেমে একই ধরনের শারীরিক কসরত করি। আমার মনে ছিল, আমি এভাবে নদীর জলে ভেসে থাকতে থাকতেই ভগবানকে পাব একদিন। একদিন এভাবেই নদীর জলে ভেসে যেতে যেতে আমার মাথা যখন একটি পাথরের গায়ে আঘাত লাগার অবস্থায় চলে এলো তখনই বাবা আমাকে সেখানে থেকে টেনে নিয়ে বললেন, আজ তুমি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছ। আজ তুমি ভগবানের দেখা পেয়েছ।”
বাবিল আরও বলেন, “বাবা মারা যাওয়ার পর লগৎপুরীর ফার্ম হাউসের সেই নদীতে জলে পা ডুবিয়ে আমি একা গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম একদিন। মনে মনে আমি যেন বাবাকে বললাম বাবা আমি আমার পায়ের নিচে কোনো জমি খুঁজে পাচ্ছি না। তখনই মনে হলো বাবা আমাকে বলছেন আজ তুমি নিজেকে সমর্পণ করেছ।”