১০ ফেব্রুয়ারি উড়োজাহাজের চাকা যখন বার্লিনের মাটি স্পর্শ করল তখন যেন রিচার্ড ভাগনার বাজাতে শুরু করলেন ‘লুহ্যানগ্রিন’। ঘড়িতে সকাল সাতটা বাজার পাঁচ মিনিট বাকি। কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু বিমানবন্দরের হলুদ আলো। আর ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে কয়েকটি বিমান দাঁড়িয়ে আছে সারি বেঁধে। হিমাঙ্ক দুইয়ের ঘরে। বাস্তবে মাইনাস দুই ডিগ্রি হলেও মনে হচ্ছে যেন মাইনাস ছয় ডিগ্রি। উড়োজাহাজের দরজা থেকে বাইরে পা দেয়ার সাথে সাথে মেরুদণ্ড হীম করা বাতাস মনে হলো সারা গায়ে কামড় বসিয়ে দিল। গায়ে গরম জামা জড়ানো থাকলেও, বাঙালি অভ্যস্ততা ধাক্কা খেল। কিছুটা কাঁপতে কাঁপতে বিমানবন্দর পুলিশ ওরফে ইমিগ্রেশনের দিকে এগুলাম। গিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেখি বিশাল লম্বা লাইন। জার্মান পুলিশটি কাচের বাক্সের পেছনে বসে যাত্রীদের কাগজপত্র পরীক্ষা করছে আর আয়েশ করে প্যাকেটজাত দুধে চুমুক দিচ্ছে। অল্পবয়সী ছোকড়াই মনে হলো।
আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বলল, এতগুলো পাসপোর্ট কেন? আমাদের এখানে তো নতুনটা আনলেই হয়। বললাম, ইমিগ্রেশনে অনেক সময় ঘোরাঘুরির ইতিহাস দেখতে চায়, তাই আগেরগুলো জুড়ে দিয়েছি। এটা বলার সাথে সাথে পাসপোর্টে ভ্রমণের ইতিহাস ঘাটতে শুরু করে দিল ছোকড়া পুলিশ। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কয়দিন থাকা হবে বার্লিনে? হেতুটাই বা কি? বললাম, বেশিদিন নয়, তাছাড়া ভিসা তো দেখতেই পাচ্ছো, হিসেব করে দিন গুনে দেয়া। বার্লিনালে এসেছি। ছোকড়া পুলিশ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বার্লিনালে? সে আবার কি জিনিস? আমিও একটু অবাক হয়ে উত্তর দিলাম, বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল! কি বুঝল জানিনা, হুম বলে পাসপোর্টে সিল মেরে, এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমিও ‘ডাংকে সেয়ার’ বলে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে চললাম বাক্সপেটরা বুঝে নিতে।
বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে সিমকার্ড কেনার মিশনে নেমে পড়লাম। বিমানবন্দরের ভেতরের দোকানটি বন্ধ। বোঝাই যাচ্ছে এত সকালে, ঠাণ্ডা ঠেলে কেউ সিমকার্ড বিক্রি করতে আসেনি। তবে যারা ছিলেন, তারা সবাই পরামর্শ দিলেন বন্দরের বাইরে গেলেই পাবে, একেবারে হাতের নাগালে। বেরিয়েই বাম দিয়ে নিচে নামবে তারপরই পাবে। কোথায় কি? বেরিয়ে দেখি সারি বেঁধে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, আর সেসবের চালকরা দূরে কাচের ভেতর আশ্রয় নিয়ে আছে। আর আমার দিকে হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করছে যাব কি না? বাইরের বাতাসে তখন আমার ‘ফ্রোজেন’ কার্টুনের এলসার মতো দশা। জমে বরফ। সিমটিম পরে হবে আগে গাড়িতে উঠি। হাত নেড়ে ডাকতেই সামনে থাকা ট্যাক্সিচালক চলে এলো। গাড়িতে উঠে বাঁচলাম। আঙুল, নাক সব জমে বরফের মতো ভেঙে যাবে মনে হচ্ছিল। গাড়ির ভেতরে থাকা হিটার বাঁচিয়ে দিল।
গাড়ি যখন চলতে শুরু করেছে, তখন বার্লিনে কেবল সূর্য উঁকি দিচ্ছে। ঘড়িতে আটটা। ঘোলা আকাশ। পথের দুইধারে পল্লবহীন বৃক্ষরাজি। সকালটা কেমন বিমর্ষ মনে হলো। বোধকরি, আমার জোড়া আর দুটো বাচ্চা ঘোড়া সাথে আসেনি বলে আরো বিমর্ষ লাগছে। আগে কান কিংবা টরন্টোতে মনে ও মনের মা সাথে ছিল। এবার ওরা এলে জেনোর জন্য প্রথম ইউরোপ সফর হতো। গাড়ির ভেতরে থাকা ওয়াইফাই ব্যবহার করে ফোন দিলাম দেশে। মনের মন বেশ খারাপ। কারণ তার বাবা বিদেশে আর স্কুলে তাকে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। আমার পরীক্ষা দিতে হবে আর কয়েক মিনিট পরই। যে অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছি, সেটি খুঁজে বের করা এবং সেখানে প্রবেশ করা।
বাড়ির ঠিকানা নাউমানস্ট্রস ১০। এই বাড়ি কিভাবে বের করব, সেটা ভাবতেই মাথায় চলে আসছিল ঢাকার কথা। ঢাকাতে এই দুই কথার ঠিকানা বের করা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু কি আশ্চর্য গাড়ির চালক দেখি ঠিকঠিক বের করে নিল। আবাসিক এলাকা। গোছানো। পার্ক আছে। স্কুল আছে। খাবারের দোকান আছে। আর ক্রমানুসারে বাড়ির নাম্বারটা দেয়া আছে। চালক ব্যাগ নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। এখন চাবি পাব কই? আর ফোনে তো ইন্টারনেট নেই। আগে দিয়ে রাখা নির্দেশনা মনে করে এগুলাম দরজার দিকে। দেখি পাশেই একটি বাক্সসদৃশ জিনিস ঝুলে আছে। এয়ারবিএনবি থেকে নেয়া হয়েছিল বাসাটি। মালিকের নাম প্যাট্রিক। লোকটির দেয়া কোড সে বাক্সে সেট করলাম। দেখি খুলে গেল বাক্স। ভেতরে চাবি। বাসায় ঢোকা তো নয়, যেন টিভির কোনো রিয়েলিটি শো। একদিকে শীতের কামড়ে আমার হাড় টনটন করছে। ঠাণ্ডায় জমে যেতে চাইছে আঙুল। তার ভেতর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চাবি বের করে লক খুলে, লাগেজ-টাগেজ নিয়ে যত দ্রুত ঢুকে পড়া যায় ভেতরে। আহ, এবারও মনে হলো বেঁচে গেলাম! এত্ত ঠাণ্ডা! আমার জোড়া, মনি, পইপই করে বলেছিল হাতমোজা নিয়ে যাও, আমি শুনিনি। এবার হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি, হাড় কাপানো শীত কাকে বলে।
আসলে আমি আর মনি বিয়ের পরপর, ২০১১ সালে লন্ডন গিয়েছিলাম। তখন হাতমোজা, টুপি দিয়ে একেবারে মুড়িয়ে বের হতাম বাইরে। সেই স্মৃতি মনে আছে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছিল বাসা থেকে স্ক্রিনিং, স্ক্রিনিং থেকে বাসা। এর মাঝে বাইরে বেরুনো নেই। এটাই ভুল হয়েছে। এখন তো খাবার কিনতে বাইরে যেতে হবে। কি আর করা! লাগেজ থেকে মোটা প্যাডিং হুডি জ্যাকেট বের করে পরলাম। আবার বেরুতে হলো! এখানে আসার পথে কফিশপ দেখেছিলাম। সেখানেই যাচ্ছি। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। লোকজন দেখি দিব্বি শুধু মোটা জামাকাপড় পরে কাজে বেরিয়েছে। আমিই একমাত্র মাথাটাথা ঢেকে অস্থির। একটু লজ্জাও হলো, ঠাণ্ডা সহ্য করার কৌশল আয়ত্ত করা এশিয় লোকেদের কর্ম নয়।
ক্যাফে মঁ শেরি নামের খাবারের দোকানে ঢুকে একটি চিজরোল, এগ স্যান্ডুইচ, দুটো বিশালাকৃতির সসেজ আর চিজি বিস্কুট কিনলাম। খুবই সস্তা এখানে খাবারের দাম। দশ ইউরোর ভেতরে সব হয়ে গেল। দোকানটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কি সুন্দর টেবিল পাতা। সকালের নাস্তাও হয় দেখলাম। পাঁচ ইউরোর ভেতর। দোকানি আমার সাথে কিছুক্ষণ সসেজ নিয়ে কথা বলল। জার্মানরা সসেজকে বলে বুকভুর্স্ট (bockwurst)। বাংলাতে সসেজের আলাদা নাম চিন্তা করে বের করতে পারলাম না। মূলত মাংসের কিমা। দোকানে আরো অনেক খাবারদাবারের পাশাপাশি দেখলাম, একপাশে ম্যাগাজিন ও পত্রিকা রাখা। আমাদের কফিশপগুলোতে চাইলেই কিন্তু ম্যাগাজিন ও পত্রিকা রাখতে পারে। লোকজন এসে চা-কফি খেল, পত্রিকা কিনে পড়ল। আমাদের দেশে লেখাপড়ার চলটাই উঠে যাচ্ছে। আগে রাস্তার পাশে পত্রিকা স্ট্যান্ড ছিল। সেখানে সেবা প্রকাশনীর বই বিক্রি হতো। এখন সেগুলোর বালাই তো নেই-ই, উপরন্তু লোকজন চড়াও হচ্ছে বইমেলাতে। বার্লিনে বসেই দেখলাম, একদল লোক তসলিমা নাসরিনের ‘চুম্বন’ বইটি রাখার প্রতিবাদ করতে এসে মেলায় হাঙ্গামা বাধিয়েছে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিজীবীরা দ্বিধাবিভক্ত। যারা আগে থেকে তসলিমাকে দেখতে পারে না, তাদের বক্তব্য গেল ত্রাসের পক্ষে। কিন্তু আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হলো আমাদের বই ও পাঠের সংস্কৃতি।
ইউরোপ ও আমেরিকায় মানুষজন পড়ে। ওরা যতই ফেসবুক আর ইউটিউব বানাক না কেন, ওরা পড়ার সংস্কৃতিকে শুধু ধরে রাখেনি, রীতিমতো উৎসাহ দিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। নয় তো মহল্লার এই চা-বিস্কুটের দোকানেও কি সুন্দর করে পত্রিকা সাজিয়ে রাখা। দেখলেই কিনতে ইচ্ছা হয়। আমার জার্মান ভাষা জানা নেই, তাই কিনলাম না। নয় তো গোটা তিনেক পত্রিকা কিনে বাসায় ফিরতাম। আসলে বিমানবন্দরে নেমেই শুনছিলাম বার্লিনে নাকি পরিবহন ধর্মঘট চলছে। বাস আর ট্রেনের শ্রমিকরা ডেকেছে। সেটি নিয়ে পত্রিকায় কি লেখালেখি হচ্ছে সেটা পড়তে চাইছিলাম। কিন্তু দেখি সেসব পত্রিকা একটিও ইংরেজিতে নয়। ওরা কি আর আমাদের মতো? আমরা দোকানপাট, ইশকুল, বাড়িঘর সব জায়গাতেই যেভাবে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিই, ওরা তো আমাদের মতো অতো ‘বুদ্ধিমান’ নয়। ওরা নিজেদের ভাষাকে তাই যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।
খাবার কিনে এনে খেয়েদেয়ে ঘুম দিতে হবে। লম্বা যাত্রা করে বার্লিন এসেছি। দুদিন পরই তো শুরু হবে কর্মযজ্ঞ। আবহাওয়ার সাথে মিলিয়ে নেয়ার ব্যাপার যেমন আছে, তেমনি আছে যাতায়াত ব্যবস্থা কোনটা সহজ সেটি পরখ করে নেয়া। এরইমধ্যে, বার্লিনে যারা ক্রিটিক জুরির দায়িত্বে আছেন, তাদের জানিয়েছি আমার আসার খবর। ২০২২ সালে কানে যখন ফিপ্রেসি বা ক্রিটিক জুরি হয়ে গিয়েছিলাম, সেবার ছিল কানের ৭৫তম আসর। কি আশ্চর্য সমাপতন, বার্লিনে এবার এসেছি ক্রিটিক জুরি হয়ে, এই ২০২৫ সালে, এবার বার্লিনালেরও ৭৫তম আসর। চলচ্চিত্র দেখার সকল তালিকা চূড়ান্ত। পার্সপেক্টিভস বিভাগ ছাড়াও আরো অনেক ছবি দেখার ইচ্ছা রয়েছে। দেখি, সময় ও পরিস্থিতি কতটুকু অনুমোদন করে।
ভেতরে ভেতরে অল্পস্বল্প উত্তেজনা কাজ করছে এটা ভেবে, যে দেশটিতে এসেছি, সেটি শুধু গ্যাটে, হাইনে, কান্ট, হেগেল, বেটোভেন, বাখ, হেরজোগ বা ফাসবিন্ডারের দেশ নয়। এটি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদ জিগফ্রিড ক্র্যাকুয়ার ও রুডলফ আর্নহেইমেরও দেশ। চলচ্চিত্র নিয়ে লেখাপড়া শুরু করার পরপরই ক্র্যাকুয়ারের ‘থিয়োরি অব ফিল্ম: রিডিম্পশন অব ফিজিকাল রিয়েলিটি’ বইটি পাঠ করেছি। প্রবন্ধ লিখেছি রুডলফ আর্নহেইমের চলচ্চিত্র চিন্তা নিয়ে, বিশেষ করে উনার ‘ফিল্ম অ্যাজ আর্ট’ বইটির মূলভাব নিয়ে। আর্নহেইম এই বার্লিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০৪ সালে। আর্নহেইমের বেড়ে ওঠার সময়টাতে বার্লিন হয়ে উঠেছিল আভাঁ-গার্দ আর্ট, সিনেমা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার নতুন ভরকেন্দ্র। দেখি, এদের লেখা মূল জার্মান ভাষার বইটই পেলে বোগলদাবা করে নেব।