নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় এখনো উত্তাল ভারত। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সরব কলকাতার শিল্পীসমাজও। বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) শ্যামবাজারে নারীদের একটি কর্মসূচি ছিল ‘রাত দখল’ । সেখানে গিয়ে প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়তে হল অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে।
শ্যামবাজারের সেই হেনস্থা প্রসঙ্গে লিখলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) সামাজিক মাধ্যমে সেই অনুভুতি ব্যক্ত করেন এই অভিনেত্রী।
ঋতুপর্ণা লেখেন- আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিহত চিকিৎসক-পড়ুয়ার জন্য সুবিচার চেয়ে ৪ সেপ্টেম্বর শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের প্রতিবাদী জমায়েতে উপস্থিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এত মানুষের প্রতিবাদ বৃথা যাবে না। আমিও সুবিচারের আশায় রয়েছি। জমায়েতে যোগ দিয়ে মোমবাতি জ্বালাই। কিন্তু, কিছু ক্ষণের মধ্যেই বদলে গেল ছবিটা। আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভের মুখে পড়লাম।
আমার উদ্দেশে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দিতে শুরু করেন অনেকে। চার পাশ থেকে উলুধ্বনি এবং শঙ্খ বাজিয়ে ব্যঙ্গ। এতে কিছু মনে করেছি, এমন নয়। কিন্তু তার পর গাড়িতে জুতো ছোড়া হল। তখন আমি দরজা খুলে বলি আপনারা এমন করবেন না। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতেই এসেছি, বসতে এসেছি। কিন্তু কেউ কোনও কথাই শুনলেন না। আসলে আমার মনে হয়, কিছু মানুষ প্রতিবাদের কথা মাথায় না রেখে, হুজুগে চলে গিয়েছিলেন জমায়েতে।
বুঝতে পারছি, সকলেই ক্ষুব্ধ। তবে, কলকাতার প্রতিবাদী চেহারার মধ্যে এই চেহারাটা দেখে আমি লজ্জিত, আহত, কম্পিত। বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাতে আমার প্রাণটাও চলে যেতে পারত। আমি একজন অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ মানুষ হিসাবে, একজন মহিলা হিসাবে অন্য মহিলার পাশে দাঁড়াতে এসেছিলাম। কিন্তু বিরাট সংখ্যক মদ্যপ এই ঘটনা ঘটাল। আচমকাই একটা জনস্রোত ধাক্কা দিতে শুরু করল। এত চিৎকার হচ্ছিল যে, কারও কোনও কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি তো কাল কোনও তারকা হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবে গিয়েছিলাম। যেখানে ঘটনাটা ঘটল, সেখানে নিহত চিকিৎসকের বাবা-মাও এসেছিলেন। ভেবেছিলাম, একবার দেখা করব ওদের সঙ্গে। বলতাম, ওদের লড়াইয়ের সঙ্গে আমিও রয়েছি। কিন্তু তা হল কই? তবে এই ঘটনার পর আমি থেমে যাব, এমন নয়। আমার মনের মধ্যে প্রতিবাদ থাকবে। আমিও একই ভাবে সুবিচার চাইব। সেটা থামবে না।
ঋতুপর্ণা লেখেন, পরিস্থিতি যে এমন হতে পারে, আমি ভাবিনি। এ তো আমার চেনা কলকাতা। আবেগের, প্রতিবাদের জনসমুদ্র। কিন্তু, বাড়ি ফিরে দেখি গাড়িতে শুধুই আঙুলের ছাপ। শুধু হাত দিয়ে মেরে মেরেই তুবড়ে দিয়েছেন গাড়িটা। সত্যি বলছি, আমার তাতে কোনও আক্ষেপ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, যারা এটা করলেন তারা নিজেরাও জানেন না কী করছেন! সবাই চিৎকার করছিলেন, তারাও চিৎকার করেছেন। একটা বর্বরতার সাক্ষী থাকলাম।
ওই রাতে আমি একা তো নয় সোহম, শোলাঙ্কিরাও ছিল। গান গাইছিল ওরা। আমি ওদের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এমন কিছুর সাক্ষী হব, ভাবতে পারছি না এখনও।
বুঝতে পারলাম না কেন এই আক্রোশ। আমি তো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমি এই শহরের সকলের সঙ্গে রাত জাগতে গিয়েছিলাম। ওই ভিড়ের মাঝে ‘চটিচাটা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে আমাকে। এমন অসভ্যতা। আসলে যারা এটা করলেন তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য আন্দোলন করা নয়। একজন তারকাকে হেনস্থা করা। কাউকে পাচ্ছেন না, সামনে ঋতুপর্ণা ছিল ব্যস্, ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমাকে অনেকেই বলেছিলেন জমায়েতে শামিল না হতে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম মানুষ হিসাবে সঙ্গে থাকব। এমন নিকৃষ্ট ঘটনা ঘটল, এখনও ঘোর কাটছে না।
আমি প্রশ্ন করতে চাই আমার সমবেদনা জানানো কি অন্যায়? একটি মেয়ের হয়ে তারা আন্দোলন করছেন আর অন্য একজন নারীকেই হেনস্থার শিকার হতে হল! আসলে হয়তো এই মানসিকতা আমাদের বর্বরতার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।