প্রয়াত কিংবদন্তি লেখক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ১৩ নভেম্বর। তার জীবন ছিল তার অভিজ্ঞতার মতোই রঙিন। জীবনের প্রতিটি বাঁকে ছিল এমন একটি গল্প, যা তার লেখা শত শত বইয়ের সঙ্গে মিলে যায়। নন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের লেখা রোমাঞ্চকর কাহিনিগুলো লক্ষ লক্ষ পাঠককে মুগ্ধ করেছে। আবার তার নিজের জীবনও ছিল অদ্ভুত ও আকর্ষণীয়।
১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ বইয়ের মাধ্যমে বাংলাসাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। তারপর গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধসহ লিখেছেন ২০০টিরও বেশি বই। তার লেখা বই দেশে বিক্রিতে শীর্ষ স্থান অর্জনের পাশাপাশি আজও প্রিয় ক্লাসিক হিসেবে পাঠকদের মনে জায়গা করে নিচ্ছে।
এরপর ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে হুমায়ূন আহমেদ একুশে বইমেলায় একাধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। অর্জন করেছিলেন, বিশ্বস্ত পাঠক শ্রেণি এবং সমালোচকদের প্রশংসা।
বাংলা সংস্কৃতি ও বিনোদনে তার অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান তাকে এনে দেয় একাধিক সম্মানসূচক পুরস্কার। যার মধ্যে রয়েছে- একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদক এবং বাচসাস পুরস্কার।
তুমুল জনপ্রিয় এই লেখকের মৃত্যুর ১২ বছর পার হলেও, এখনও হুমায়ূন আহমেদের জীবন উদযাপিত হচ্ছে এবং তার ভক্তরা তার গঠনমূলক কাহিনিগুলো স্মরণ করে আনন্দিত হন। এমনই একটি গল্প হলো, কীভাবে তিনি তার প্রথম রঙিন টেলিভিশন কিনেছিলেন।
১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করা হুমায়ূন আহমেদ ৭০ এর দশকের শুরুর দিকে লেখালেখি শুরু করেন।
তার প্রথম দুটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তাকে বাংলা সাহিত্যে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়। তবে, তার টেলিভিশনের জন্য লেখা স্ক্রিপ্টই তাকে মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে পরিচিত এক নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
সেই সময়, বিটিভি ছিল একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল। কিন্তু হুমায়ূনের লেখার বিশেষ ধরন– তার গল্প বলার অনন্য ভঙ্গি, জীবন সম্পর্কিত সংলাপ এবং আকর্ষণীয় কাহিনিগুলো তাকে এই দেশের ঘরে ঘরে পরিচিত করে তোলে।
তার প্রথম দিককার নাটকগুলো, যেগুলো এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দেখা যায়, আজও আগের মতোই দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে।
টেলিভিশনে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে ‘প্রথম প্রহর’ নাটক দিয়ে। এটি ছিল বিটিভিতে তার প্রথম নাটক। তবে, তার যুগান্তকারী ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাকে আকাশচুম্বী খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এই নাটকটি ১৮টি পর্বে ছয় মাস ধরে প্রচারিত হয়েছিল এবং প্রতিটি পর্বের জন্য দর্শকরা দুই সপ্তাহ পরপর অপেক্ষা করতেন।
‘এইসব দিনরাত্রি’ হুমায়ূন আহমেদের খ্যাতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। বাস্তবে, ধারাবাহিকের একটি চরিত্র টুনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারা যায়। তার মৃত্যু সমস্ত দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
টুনির মৃত্যুর সাথে অনেকটাই হুমায়ূনের নিজের ক্যান্সারে মারা যাওয়ার ঘটনা মিলে যায়। তিনি ২০১২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান। অদ্ভুতভাবে হুমায়ূন আহমেদ একবার জানিয়েছিলেন, ‘এইসব দিনরাত্রি’ তিনি অত্যন্ত ব্যক্তিগত কারণে লিখেছিলেন। তিনি ধারাবাহিকটি থেকে টাকা উপার্জন করে একটি রঙিন টেলিভিশন কিনতে চেয়েছিলেন।
তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘বলপয়েন্ট’-এ লিখেছিলেন, ‘বাসায় কোনো টেলিভিশন নেই। নোভা-শীলা টেলিভিশন দেখার জন্যে পাশের ফ্ল্যাটে যায়! টেলিভিশনে বাংলাদেশ প্রোগ্রাম দেখতে তাদের না-কি খুব ভালো লাগে। তখন এত চ্যানেল হয় নি। বিটিভি সবেধন নীলমণি।’
"এক রাতের কথা। মেয়েরা খুব আগ্রহ করে টিভি দেখতে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ফিরে এসে জানালো, ঐ ফ্ল্যাটে মেহমান এসেছে। কাজেই তাদের আজ টিভি দেখতে দেয়া হবে না। বাচ্চারা খুবই মন খারাপ করল। তাদের চেয়েও মন খারাপ করল বাচ্চাদের মা। কেন বাংলাদেশে এসেছি? কী পাচ্ছি বাংলাদেশে? একটা টিভি কেনার সামর্থ্য নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।"
"রাতে ভাত খাবার সময় বড় মেয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাদের একটা টিভি কিনে দেবে?
আমি বললাম, দেব।
রঙিন টিভি?
আমি বললাম, অবশ্যই রঙিন টিভি।
কবে কিনে দেবে?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। তবে একটা রঙিন টিভি যেভাবেই হোক কিনতে হবে এটা মাথায় ঢুকে গেল।"
"বিটিভির নওয়াজীশ আলি খান সাহেবের সঙ্গে তখন আমার সামান্য পরিচয় হয়েছে। আমার একটি নাটক তিনি বিটিভিতে প্রচার করেছেন। নাম খুব সম্ভব ‘প্রথম প্রহর’। তিনি আমাকে একটি ধারাবাহিক নাটক লিখতে বলছেন। আমি ধারাবাহিক নাটক লিখতে রাজি হলাম। ঠিক করলাম, একটি রঙিন টিভি কিনতে যত টাকা লাগে তত টাকার ধারাবাহিক নাটক লেখা হবে। যে নাটকটি লিখলাম তার নাম ‘এইসব দিনরাত্রি’।"
বইয়ে হুমায়ূন আহমেদ উল্লেখ করেন, "এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিক নাটকটি প্রচার হবার পর এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, এই ধারাবাহিক নাটকটি লেখার পেছনে আপনার মূল প্রেরণ কী ছিল?”
“আমি বললাম, অর্থ উপার্জন। আমার একটি রঙিন টিভি কেনার প্রয়োজন ছিল বলেই ধারাবাহিক নাটকটি লিখেছি।"
“সাক্ষাৎকার প্রচার হবার পরপরই এই নাটকে যারা অভিনয় করেছেন তারা আহত হলেন। বিশেষভাবে রাগলেন প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের। তিনি বললেন, আমরা এত আবেগ নিয়ে এই নাটকে অভিনয় করেছি, আর হুমায়ূন আহমেদ বলে দিলেন তিনি সামান্য একটা রঙিন টিভির জন্যে নাটক লিখেছেন।”
অভিনেতাদের তপ্ত বক্তব্য পত্রিকায় ছাপা হাতে লাগল। বাধ্য হয়ে একদিন আমি আবুল খায়ের সাহেবকে ডেকে পাঠালাম। আমি বললাম, ভাই, আপনি যে অভিনয় করেছেন তার জন্যে কি বিটিভির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ নিয়েছি।
আমি বললাম, আমিও ঠিক তাই করেছি। নাটক লেখার জন্যে টাকা নিয়েছি। আপনি হৈচৈ করছেন কেন? একজন লেখক চাঁদের আলো খেয়ে বাঁচেন না। তাকে প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট খেতে হয়।
আপনি কেন বললেন, রঙিন টিভি কেনার জন্যে নাটক লিখেছেন?
যেটা সত্যি আমি তাই বলেছি। আপনাকে ডেকেছি রঙিন টিভিটা দেখার জন্য। নিজের চোখে দেখুন আমার বাচ্চারা কত আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখছে। বেতনের টাকা দিয়ে বাচ্চাদের এই টিভিটা কিনে দেবার সামর্থ্য আমার ছিল না।
আবুল খায়ের সাহেব খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ আমার বাচ্চাদের সঙ্গে টিভি দেখলেন। একসময় তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ভুল করেছি। ক্ষমা চাই।
খায়ের ভাইয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। নতুন কোনো নাটক বানাতে গেলেই আমার তার কথা মনে পড়ে। খায়ের ভাইয়ের সমকক্ষ অভিনেতা বাংলাদেশে আছে বলে আমি মনে করি না।"