বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সোমবার (৫ আগস্ট) পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। আন্দোলনের শুরু থেকেই সরব ছিলেন কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা পরমব্রত । দেশে যখন নতুন সরকার গঠন করা নিয়ে আলোচনা চলছে ঠিক সেই মুহুর্তে বিজয়ী বিপ্লবী ছাত্র-জনতার কাছে সরকার গঠনে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে এই নায়ক। কলকাতার আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশ হওয়া লেখাটি সংবাদ প্রকাশ অনলাইন পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল-
ছাত্ররা সেনাবাহীনি বা রাজনৈতিক দলের নয়, বরং সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, এমন সরকার ছাড়া কোনও সরকার মানবেন না এই ঘোষণা করেছেন। এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দিয়েছেন। সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। মনে রাখতে হবে এক ফ্যাসিস্টকে সরিয়ে আরও বড় ফ্যাসিবাদকে জায়গা করে দেবেন না।
গণতন্ত্রকামী এই আন্দোলনকে সসম্মানে গণতান্ত্রিক ভাবে প্রতিষ্ঠা দিন। এসময় তিনি বিজয়ী ছাত্রদের অভিনন্দনও জানান।
পরমব্রত লেখেন, এক মাসের কিছু আগে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনের উপর সে দেশের সরকার ক্রমাগত যে আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছে, তা ন্যক্কারজনক এবং বর্বরোচিত তো বটেই, একচ্ছত্র ক্ষমতার মোহে অন্ধ শাসকের মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা না দেওয়ার চরম উদাহরণও বটে। আমরা সকলেই কমবেশি জানি, এই আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা কেন্দ্র করে শুরু হলেও সরকারের নানা অগণতান্ত্রিক এবং একনায়কোচিত পদ্ধতি নিয়ে জমতে থাকা মানুষের রাগ ফেটে বেরিয়ে এই আন্দোলনকে এক বৃহৎ চেহারা দেয়। যা আজ এক চরম পরিণতি পেয়েছে।
সরকারের পদত্যাগ যদি ছাত্রদের সর্বশেষ এবং একমাত্র দাবি বলে ধরে নিই, তা হলে তাদের অবশ্যই অভিনন্দন জানাতে হয়। কিন্তু এই প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন না তুলে পারছি না। অনেকের কাছে অপ্রিয় হতে পারি জেনেও। এগুলোকে প্রশ্ন না অনুরোধ বলব ঠিক জানি না। হয়তো দুটোই!
বাংলাদেশের মাননীয় সেনাপ্রধান তার বিবৃতিতে বললেন এবং পরে তা ছাপার অক্ষরে পড়লামও যে, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আলোচনা করেছেন সুশীল সমাজ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামাত নেতৃত্বের সঙ্গে।
কথা হল, আন্দোলন তো করলেন আপনারা ছাত্ররা। সেই আন্দোলনের বিজয় মুহূর্তে আগামীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে আপনাদের প্রতিনিধিত্ব নেই কেন? আপনাদের আন্দোলনের তো কোনও ধর্মীয় রং ছিল না বলেই জানি! তা হলে জামাত এত গুরুত্ব পাচ্ছে কেন? কেনই বা জনৈক আন্দোলনকারী হিন্দু ছাত্রকে সমাজমাধ্যমে বিস্ময় প্রকাশ করতে হচ্ছে যে, তাঁর বাড়ি কেন আক্রান্ত হচ্ছে?
এক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি দেখলাম একটি পোস্ট দিয়েছেন, ‘যে মসজিদ থেকে মানুষকে এক হওয়ার ডাক দিয়েছেন, সেই মসজিদ থেকেই সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার ডাক দিন। আর একটি পোস্টে পড়লাম, ‘কালীবাড়ি রক্ষা করছেন মাদ্রাসার ছাত্রেরা।’ সত্যিই ভাল লাগল পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ সবের প্রয়োজন পড়ছে কেন?
‘বিজয়োল্লাসে’ মত্ত কিছু মানুষ দেখলাম বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙছেন, গণভবন লুটপাট করছেন। শুনলাম ৩২ নম্বর ধানমন্ডি এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে! কারাগার ভেঙে দেওয়ায় বন্দিরা পালাচ্ছেন। সাবেক শাসকদলের সাংসদদের বসতবাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এমনকি পিটিয়ে হত্যাও চলছে। বাংলাদেশের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক তথা আওয়ামী লীগের সাংসদ মাশরাফির বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়েছে।
যে আন্দোলন ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’ বা ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে, গর্বিত ভাবে দেশের পতাকা মাথায় এঁকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন আপনারা, ছাত্রেরা, বিশ্বাস করি না তাঁরা এই কাজগুলি করতে পারেন! তা হলে? ওত পেতে থাকা কিছু স্বাধীনতা-বিরোধী, কট্টরপন্থী শক্তি আপনাদের এই অসামান্য আন্দোলন হাইজ্যাক করে ফেলছে না তো? আপনার হয়তো বলবেন ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ। কিছু বেনোজল তো ঢুকবেই! মানুষ এত দিনের রাগ একটু তো দেখাবেই!’ হয়তো তা-ই। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, আন্দোলন থেকে এদের সরিয়ে রাখা বোধ হয় এই আন্দোলনের স্বার্থেই দরকার!
আসলে ঘরপোড়া গরু তো! সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় হয়। বার বার শুনছি ‘বাংলা বসন্ত’ বলা হচ্ছে এই মুভমেন্টকে! মনে পড়ছে ‘আরব স্প্রিং’-এর কথা। আর এ-ও মনে পড়ছে যে, সেই বসন্তের ফল অধিকাংশ জায়গায় ভাল হয়নি। কট্টরপন্থী মৌলবাদী শক্তি হাইজ্যাক করেছে সেই মুভমেন্টকে, মধ্যপ্রাচ্য তলিয়ে গিয়েছে গৃহযুদ্ধ এবং অশেষ রক্তপাতের গহ্বরে। আমি যে দেশের নাগরিক, সেই দেশেও কিন্তু যন্তর মন্তরে অণ্ণা হজারের সমর্থনে আন্দোলন, ভ্রষ্টাচার-বিরোধী আন্দোলন দশ বছর আগে ডেকে এনেছিল এমন এক শক্তিকে, যার নীতিগত বিরোধিতা আমাদের মতো লোকেরা আজও করে চলেছি! এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, ভারতের সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল কিন্তু কিছুটা হলেও প্রমাণ করে দিয়েছে, শত মেরুকরণ সত্ত্বেও মানুষ কোনও ধর্মগ্রন্থ নয়, সংবিধান দ্বারা চালিত হতে চান!
নাহ্, কুডাক ডাকতে চাই না মোটেই। বরং আশা করতে চাই যে, আপনারাও তা-ই চান এবং চাইবেন। আর উপরে করা প্রশ্নগুলো সামনে রেখে এ বার অনুরোধ করতে চাই।
আজ আপনাদের গৌরবের দিন! যে গর্বের আঁচ আমাদের গায়েও এসে লাগছে! নিশ্চয়ই উল্লাসেরও দিন! কিন্তু স্বৈরাচারকে পরাস্ত করার এই আনন্দকে কালিমালিপ্ত হতে দেবেন না! এক ফ্যাসিস্টকে সরিয়ে আরও বড় ফ্যাসিবাদকে জায়গা করে দেবেন না! গণতন্ত্রকামী এই আন্দোলনকে সসম্মানে গণতান্ত্রিক ভাবে প্রতিষ্ঠা দিন, শুধু গলার জোরে ! গায়ের জোরে নয়।
লিখতে লিখতে এখনই খবরে পড়লাম, ছাত্রনেতারা সেনা বা অন্য রাজনৈতিক দলের নয়, বরং সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, এমন সরকার ছাড়া কোনও সরকার মানবেন না এই ঘোষণা করেছেন। এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দিয়েছেন! প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ! অভিনন্দন।
পরিশেষে বলি, ঢাকার শাহবাগে বা টিএসসি-তে আমার যে বন্ধুরা উৎসবে মেতেছেন, তাঁদের ক্ষুণ্ণ করার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই! বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মানুষই তৈরি করবেন। সেটাই উচিত এবং সেই সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নিশ্চয়ই নেই। করতে আমি চাইও না! আমি ভারতীয়। কিন্তু যাঁরা আমাকে চেনেন, বিশেষত আমার বাংলাদেশের বন্ধুরা, তাঁরা জানেন, আমার কাছে আমার ‘বাঙালি’ পরিচয়টা কতটা গর্বের! বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আর পাঁচজন ভারতীয়ের মতো ‘পেশাদার’ তো নয় বটেই, আর পাঁচজন পশ্চিমবঙ্গবাসীর মতোও নয়! সম্পর্কটি অনেক বেশি আত্মিক এবং প্রকৃত অর্থে আত্মীয়তার! টানটা নাড়ির! তাই হয়তো একটু অনধিকার চর্চাই করে ফেললাম! মাফ করবেন!
সূত্র: আনন্দবাজার