শুধু ‘রবি’ নামধারীদেরই কেন বিশ্বজুড়ে সৃষ্টির মশাল বহন করতে হয়? অজানা এর উত্তর। জানা শুধু ১৯২০ সালের আজকের দিনে, অর্থাৎ ৭ এপ্রিল বেনারসে জন্ম হয় রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী নামের ভারতের সেতার মায়েস্ত্রোর। এই রবি শঙ্কর একক কৃতিত্বে বিশ্বে পরিচিত করেছেন ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীত। তার পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইলে। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও জন্মের এই ঠিকুজি জানা ছিল রবির। ১৯৭১ সালে হানাদার সামরিক জান্তা আক্রান্ত দেশটির জন্য তিনি জর্জ হ্যারিসন ও তার বন্ধুদের সঙ্গে মিলে আয়োজন করেছিলেন সাড়া জাগানো ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর ছিলেন রবির বড় ভাই। আট বছর বয়স থেকে তিনি একই সঙ্গে সেতার বাজানো ও নাচ শিখতে থাকেন। শৈশবেই বড় ভাইয়ের নাচের দলের সঙ্গে একক নৃত্যশিল্পী ও সেতার বাদক হয়ে চষে বেড়িয়েছেন ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন শহর।
এভাবে ১৮ বছরে পা রাখেন রবি। শেখার নেশা তখন তার তীব্র। চলে আসেন ভারতের মাইহারে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের কিংবদন্তি গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের কাছে। তিনি সেতারের দীক্ষা নিতে থাকেন তার থেকে। একই সময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে সরোদ মায়েস্ত্রো ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গে। এই জুটি পরবর্তীকালে বিশ্ব মাতিয়েছেন সেতার-সরোদের যুগলবন্দীতে। গুরুগৃহে রবি শঙ্করের শিক্ষা গ্রহণ পর্ব ছিল ১৯৩৮ হতে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত।
৪০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে রবি শঙ্কর সেতার বাদক থেকে সংগীত পরিচালক রূপে পরিচিত হতে থাকেন। তিনি কবি আল্লামা ইকবালের ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ কবিতায় সুরারোপ করেন। ব্যাপকভাবে নন্দিত হয় তা। এরপর তিনি সংগীত পরিচালনা করেন সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি অপু ট্রিলজির (পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার)। তিনি সক্রিয় ছিলেন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র সংগীত পরিচালক হিসেবেও
নিজে বাজিয়ে ও কমপোজিশনে তারকা রবি শঙ্কর কীর্তিগুণেই হয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রাণান্ত ছিলেন বাদ্যযন্ত্র সেতার ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বিস্তারে। একটির পর একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখ করা যায় বৈদ্য বৃন্দ চেম্বার অর্কেস্ট্রা, কিন্নর স্কুল অব মিউজিক বম্বে এবং কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, লস অ্যাঞ্জেলস।
১৯৬৬ সালে বিটলস্ তারকা জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে পরিচয় হয় রবির। এ জুটির কাজে তুমুল নিরীক্ষা চলে জ্যাজের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মিশ্রণে। আমাদের আক্রান্ত মাতৃভূমির জন্য ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর মতো ঐতিহাসিক আয়োজনে এ জুটি নিজেদের সর্বস্ব নিংড়ে দেয়। কনসার্টের আয় থেকে সহায়তা করা হয় তখনের শরণার্থী বাঙালিদের।
মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগেও সেতার পরিবেশন করেছেন ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব জয়ী পণ্ডিত রবি শঙ্কর। তার কন্যা নোরাহ জোনস ও আনুস্কা শঙ্কর হাঁটছেন বাবার দেখানো সংগীতের পথে।
২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ৯২ বছর বয়সে থেমে যায় রবির সব সুর। অনন্তলোকে পাড়ি জমান তিনি। রবি শঙ্কর ছিলেন দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক কর্মজীবনের জন্য গিনেস রেকর্ডের অধিকারী। তার বিপুল সৃষ্টি কাছে না ফিরে উপায় থাকে না। জনযুদ্ধরত জাতির সহযোদ্ধা হওয়ার জন্যও রবির প্রতি ঋণ অশোধ্য। সুরে সুরে তিনি বাঁচবেন। ‘বাংলা ধুন’ এ বারবার ফিরে আসবেন। পাঁজরের হাড়ের মতো সেতারের তারকে ভালোবাসা এ কীর্তিমানের জন্মবার্ষিকীতে অনন্ত শ্রদ্ধা।