ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (ডিফ) বাংলাদেশে তিন দশকের বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। শনিবার (১২ অক্টোবর) উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক একাউন্ট থেকে দেশের সকল চলচ্চিত্রপ্রেমী ও সরকারকে বরাবরের মতো ডিফের পাশে থাকার আহ্বান জানান। পাশাপাশি উৎসব সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণারও উত্তর দেন। ফেসবুক পোস্টে দেয়া তার পুরো বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলো:
“নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ-- এই স্লোগান সামনে রেখে ১৯৯২ সাল থেকে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি আজ অবদি নিয়মিত আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও বড় চলচ্চিত্র উৎসব, যা উপমহাদেশে অদ্যাবধি ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব নামে সুপরিচিত, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার চলচ্চিত্র অঙ্গনে সকলের কাছেই সুপ্রতিষ্ঠিত।
গুণগত ও পরিমাণগত ব্যপ্তিতে এই উৎসব এতটাই সুনাম অর্জন করেছে যে, প্রারম্ভিককাল থেকেই উৎসবটিকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সমাজের মানুষ ও রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত এমন বৃহৎ পরিসরে উৎসব সম্ভব নয়। কান, বার্লিন ও ভেনিসের মতো ঢাকাতেও এই উৎসব পালনে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি সকল আমলেই সরকারের সহযোগিতা পেয়ে আসছে। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে শুধু নয়, জাতীয় পর্যায়ে চলচ্চিত্রচর্চা বেগবান করতে এই উৎসব অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে বলেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সকল সময়েই বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। যেমন এই উৎসবে বাইরে থেকে অনেক বিখ্যাত নির্মাতা, শিল্পী ও গণ্যমান্য অতিথিরা আসেন, তাদের আগমন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছাড়া অসম্ভব। উৎসবে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলো বিধি মোতাবেক সেন্সর করাতে হয়, সেক্ষেত্রে সুহৃদের ভূমিকা পালন করে তথ্য মন্ত্রণালয়। সেন্সর বাবদ যে অর্থ ফি হিসেবে প্রদেয় হয়, সেটি ছাড় দেওয়া ছাড়াও, অর্থ অনুদান দিয়ে পাশে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়। এবং সর্বোপরী সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় উৎসবের জন্য বিভিন্ন ভেন্যুর ব্যবস্থা করে দিয়ে প্রতিবারই কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটিকে। সব সরকারের আমলে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, ১/১১ সরকার সব সরকারের আমলে তিন/ চার মিনিস্ট্রি নিয়ে কাজ করছে। আর আলাদা করে ধন্যবাদ দিতে হয় ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারত, চীন, ইরান প্রভৃতি দেশের দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে। তারাও ভেন্যু ও অতিথিদের আনার ব্যাপারে বিশাল ভূমিকা পালন করে।
রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি মনে করে, উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও এই উৎসবকে বিশ্বদরবারে ‘সফট পাওয়ার হিসেবে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে চলা এই উৎসব বাংলাদেশ ও এদেশের বোদ্ধা দর্শক ও প্রতিভাবান নির্মাতাদের সঙ্গে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সেতুবন্ধন নির্মাণ করতে পেরেছে বলে আমাদের ধারণা। উৎসবের পরিচালক হিসেবে আমি সবসময়ই চেষ্টা করেছি দল ও মতের উর্ধ্বে থেকে, উৎসবটিকে নির্দলীয় জায়গা থেকে পরিচালনা করতে, আর সেটা সফলভাবে তিনদশকের বেশি সময় ধরে করতে পেরেছি বলেই, সকল রাজনৈতিক ও নির্দলীয় সরকারের আমলে আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে সফল আয়োজন করতে পেরেছি এবং উৎসাহ পেয়েছি দেশের বিভিন্ন প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বোদ্ধাদের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ের প্রতি আস্থা রেখে রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ যেভাবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, তার পেছনে নিঃসন্দেহে রয়েছে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ভালোবাসা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আনুকূল্য। কিন্তু তার মানে এই নয়, উৎসব সর্বদা বেশ নির্ঝঞ্ঝাটভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনেকবার উৎসব বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, শুধু চলচ্চিত্রচর্চার প্রতি সততা আর একনিষ্ঠতা দিয়ে আমরা সেসব প্রতিবন্ধকতা উৎরে গিয়েছি। চলতি বছরও (২০২৪) তেমন এক ঘটনা ঘটে উৎসব শেষ হওয়ার পরপরই।
২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব চলাকালে কোনো অভিযোগ না উঠলেও, উৎসব শেষ হওয়ার পরপরই, একটি মহলের ভেতর ফিপ্রেসি পুরস্কারপ্রাপ্তদের ব্যাপারে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং তারা পূর্বাপর না জেনে অনেকটা ‘ উৎসববিরোধী’ কাজে লিপ্ত হয়। তারা ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মান ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করতে বিদেশী সংস্থার কাছে অভিযোগ করে বসে। অভিযোগটি এমন, উৎসব কমিটিতে থাকা মফিদুল হক কেন ফিপ্রেসির জুরি বোর্ডের সদস্য হবেন? সেজন্য তারা ধারাবাহিকভাবে জার্মানিতে চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম ফিপ্রেসির কার্যালয়ে চিঠি লেখে। বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করায়, ফিপ্রেসি মূল কার্যালয় ফিপ্রেসির ঢাকা চ্যাপ্টার ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিকস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ইফক্যাব) তিন মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞার ভেতর ফেলে। কিন্তু ফিপ্রেসির লিখিত নিয়মাবলী থেকে আমরা যখন উপযুক্তভাবে প্রমাণ করি, ঢাকা উৎসবে কোনো নিয়ম লঙ্ঘিত হয়নি, তখন সেই তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে, তারা বাংলাদেশ থেকে সাদিয়া খালিদ রিতিকে ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফিপ্রেসি জুরি হিসেবে মনোনীত করে।
বিষয়টি ছিল এমন: উৎসব কমিটির কেউ যদি ফিপ্রেসির জুরি হন তাহলে তিনি উৎসবে জমাকৃত কোনো ছবির সাথে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না, যদি হনও, তাহলে উৎসব পরিচালকের বিশেষ অনুমতিক্রমে সেটা হতে পারবেন, এবং ওই ব্যক্তি উৎসবের সাথে আর্থিক ও শৈল্পিকভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন না। এখন জনাব মফিদুল হক বাংলাদেশের একজন শ্রদ্ধেয় ও স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও লেখক। তিনি দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যোগে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন। একইভাবে তিনি ছিলেন উৎসব কমিটিতে। কিন্তু তিনি উৎসবের সাথে আর্থিক বা শৈল্পিকভাবে যুক্ত ছিলেন না, সম্পৃক্ত ছিলেন না উৎসবে জমা দেওয়া কোনো চলচ্চিত্রের সাথেও। এটা প্রমাণিত। পুরো বিষয়টি বোঝানোর পর ফিপ্রেসি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়, যার ফলস্বরূপ রিতি কান উৎসবে যায়। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা কেন উঠিয়ে নেয়া হলো, সেটি নিয়েও চিঠির পর চিঠি লেখা হয়েছে জার্মানিতে। এক পর্যায়ে ফিপ্রেসির কর্ণধাররা বুঝতে পারেন, এটি একটি গোষ্ঠীর কাজ এবং তা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এরপর ফিপ্রেসি চিঠির মাধ্যমে ও মৌখিকভাবে ঢাকা চ্যাপ্টারের সাথে ফিপ্রেসির সুদীর্ঘ সম্পর্ক যেন নষ্ট না হয় এবং অব্যহত থাকে সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে। কিন্তু ওই বিশেষ মহল বিষয়টি নিয়ে অযথা কাদা ছোড়াছুড়ি করে চলেছে। তারপরও ফিপ্রেসির ঢাকা চ্যাপ্টার এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ঝামেলা এড়িয়ে নিজেদের কাজ করে যাওয়ার স্বার্থে।
এমন পরিস্থিতিতে আমরা এটুকুই বলবো, বিগত তেত্রিশ বছর, দেশের মানুষ ও সরকার যেভাবে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে ভালোবেসে, এর পাশে থেকে সমর্থন যুগিয়ে গেছে, একইভাবে ভবিষ্যতে তা অব্যহত রাখবে। এই উৎসবের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষ চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে আত্মনিয়োগ করেছেন। তাদেরকে হেয় করার অর্থ উৎসবের মর্যাদাহানি করা। আমরা প্রত্যাশা করি, গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে যে নতুন ব্যবস্থার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ রয়েছে, সেখান থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।"