অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। রোববার (১০ নভেম্বর) বঙ্গভবনে শপথ নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি তার নিয়োগ নিয়ে কড়া সমালোচনাও হচ্ছে। ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তার বিরুদ্ধে মিছিল ও নিন্দা জানিয়েছেন অনেকে।
এ বিষয়ে ফারুকী প্রথমবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এই স্ট্যাটাসে তিনি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন এবং ফেসবুকে তাকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। ফ্যাসিস্টের দোসর বলায় বিস্মিত হয়ে প্রশ্নও ছুঁড়েছেন উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
ফারুকী তার পোস্টে লিখেছেন, ‘ঘুণাক্ষরেও যা আগে ভাবি নাই, এখন আমাকে সেটাই করতে হচ্ছে। যাই হোক শুরু করি। আমি মাত্রই দুই দিন হলো কাজ করছি। এর মধ্যে আমার ধারণা আমার মন্ত্রণালয়ে সহকর্মীদের মাঝে এই ধারণা দিতে পেরেছি যে আমরা কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটাতে চাই, যেটা স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের কাজে আসবে। যা–ই হোক, যদিও আমি কোনো পদ চাই নাই, তবুও দায়িত্বটা নেওয়ার পর আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে করার চেষ্টা করছি।’
উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় কেউ কেউ মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে বলছেন ফ্যাসিস্টের দোসর। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু এর মধ্যে আমাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে এক অবিশ্বাস্য অভিযোগের—আমি নাকি ফ্যাসিস্টের দোসর! যেই ফ্যাসিস্টকে তাড়ানোর জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালাম ১৬ জুলাই থেকে, অল আউট অ্যাটাকে গেলাম এটা জেনে যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা টিকে গেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু অথবা জেল, আমি তারই সহযোগী?’
জনপ্রিয় এই নির্মাতা লিখেছেন, ‘উপদেষ্টার চেয়ারের জন্য কোনো সাফাই দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না; কিন্তু শিল্পী হিসেবে অপমানিত বোধ করেছি বলেই কয়টা কথা বলছি।’
শাহবাগ আন্দোলনে সমর্থন নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। ‘শাহবাগ আন্দোলন যখন শুরু হয় আর সবার মতো আমিও ভেবেছিলাম এটা নির্দলীয়। যে কারণে আমার সব পোস্টে এটাকে ঠেলে “রাষ্ট্র মেরামতে” এজেন্ডার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন বুঝে যাই, তখনই লিখি “কিন্তু এবং যদির খোঁজে”। যে কিন্তু এবং যদি শাহবাগ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে আজকের যে ফ্যাসিবাদের সূচনা করা হয়েছিল, তার প্রতিবাদে লিখি, “এই চেতনা লইয়া আমরা কি করিবো”।’
পরিচালক হিসেবে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা থেকে তিনি কখনোই বিরত থাকেননি। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বিভিন্ন সময় তিনি হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন উল্লেখ করে ফারুকী বলেন, ‘একজন লেখক যতটা স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন, ফ্যাসিবাদের কালে আমার সেই স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। তার মধ্যেও যতটুকু করেছি, তার ফলও আমাকে ভোগ করতে হয়েছে। ২০১৫ সালে সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন সেলের হেনস্তার শিকার হওয়ার মধ্যে যে দীর্ঘ অত্যাচারের শুরু। সেই বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আমার সিমপ্যাথি পাওয়ার ইচ্ছা এবং প্রয়োজন নাই।’
কেউ কেউ তাকে ভারতীয় দালাল হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। এর বিপক্ষে এই ফারুকী লিখেছেন, ‘অনেকে বলছে, আমি ভারতীয় হেজেমনির অংশ। যে লোককে বাংলাদেশের কালচারাল এস্টাবলিশমেন্ট ঘৃণা করে আমি কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষার হেজেমনি ভেঙে দিয়েছি বলে, সেই কি না এই হেজেমনির অংশ। আমি পৃথিবীর কোনো দেশেরই ঢালাও নিন্দা করি না। কারণ, দেশে নানা চিন্তার মানুষ থাকে। আমি সবার সঙ্গেই কথা বলতে চাই, কাজ করতে চাই; কিন্তু আমার দেশের ক্ষতি হলে আমি তার বিরুদ্ধে বলতে কুণ্ঠা করি না। ফেলানীর মৃত্যুর পর কী পোস্ট দিয়েছিলাম, ২০১৩ সালে সেটা দেখতে পারেন।’
ফারুকী লিখেছেন, তার অবস্থানের কারণে ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়তে হয়। অনেকে তাকে গালাগালও করেন। এ নিয়ে তিনি নিজেও ভয়ে থেকেছেন। কথা বলার সময়ে সতর্ক থাকতে হতো। যা তার ব্যক্তিগত জীবনেও নানাভাবে প্রভাব ফেলে। ফারুকী লিখেছেন, ‘আমার মনে আছে ২০১২ সালে শুধুমাত্র কথা বলার জন্য আমি আর “আরিফ আর হোসাইন” লুকিয়ে আমেরিকান ক্লাবে গিয়ে বসে আলাপ করতাম কীভাবে এই জালিম সরকারকে হটানো যায়। বিএনপি এবং জামায়াত কিছু করতে পারবে? আর্মির মনোভাব কী? জোনায়েদ সাকির সঙ্গে বাটন ফোনে কথা বলে গোপনে দেখা করতাম আর পরামর্শ করতাম কী করা যায়। সেই আমি আওয়ামী ফ্যাসিজমের পার্ট?’
পোস্টের শেষে নতুন এই উপদেষ্টা ফারুকী লিখেছেন, ‘আমি তো কোনো বিপ্লবী নই। ছিলাম না কোনো কালে। আমি ফিল্মমেকার। ঘটনাচক্রে এবং আল্লাহর রহমতে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমি আমার সেই পরিচয়েই গর্বিত। আমি মারা গেলে আমাকে ফিল্মমেকার হিসেবেই মনে রাখা হবে, মন্ত্রী হিসেবে না। ফলে মন্ত্রিত্ব আমার কাছে কোনো অর্জন না, পাবলিক সারভেন্টের দায়িত্ব মাত্র। আমি এটা ফাইনালি অ্যাকসেপ্ট করেছি নিজের ফিল্মের বাইরেও আমার দেশকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছে, এটা বিশ্বাস করেছি বলে। আমার মনে হয়েছে, জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজের লাভ-ক্ষতি না ভেবে এই ক্ষমতা দেশের কাজে লাগাই। লাস্টলি, আই অ্যাম লাভিং মাই জব। বাট আই অ্যাম হেইটিং দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট আই হ্যাড টু রাইট দিস!’