শ্রাবস্তী দত্ত তিন্নি। দেশের এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী। ২০০৪ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘৬৯’ ধারাবাহিক নাটকে দীপা চরিত্রে অভিনয় করে সবার নজরে আসেন তিন্নি।
পরের বছরই একই পরিচালকের একটি বিউটি সোপে মডেল হয়ে রাতারাতি স্টার হয়ে ওঠেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দাপটের সঙ্গে কাজ করে গেছেন তিন্নি। টানা ২০১০ সাল পর্যন্ত অভিনয় করে গেছেন তিনি।
‘অপেক্ষা’, ‘নীল কুয়াশা’, ‘সুখের অসুখ’, ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করে সবার মন কেড়েছিলেন। সিনেমাতেও অভিষেক হয় তার। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, নূরুল আলম আতিকের ‘ডুবসাঁতার’। একসময় শাকিব খানের সঙ্গে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতেও অভিনয় করেন। ছবিটি মুক্তির পর তিন্নিকে দর্শক গ্রহণ করেছিল।
কিন্তু নিজের অনিয়ন্ত্রিত জীবনের ফাঁদে পড়ে জনপ্রিয়তার মধ্যগগন থেকে ছিটকে যান তিন্নি। প্রায় এক যুগ আগের ছোটপর্দার তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী এখন দিন কাটে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে। কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে তার বসবাস।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে মেয়ে ওয়ারিশাকে নিয়ে বসবাস করছেন শ্রাবস্তী দত্ত তিন্নি। কেমন আছেন সেখানে, কী করছেন, কীভাবে দিন কাটছে সেই অভিনেত্রী ও মডেলের।
সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে তিন্নি জানান, নিজের মতো করে মেয়ে ওয়ারিশাকে নিয়ে ভালোই আছেন তিনি।
অভিনেত্রী বলেন, ‘কানাডা আর বাংলাদেশের জীবনের আকাশ-পাতাল পার্থক্য, ‘আগে মিডিয়ায় নিজের মতো করে কাজ করতাম, চলতাম, খেতাম এবং জীবনযাপন করতাম। এখানকার বাস্তবতা কঠিন। সকাল ৬টায় উঠে রেডি হয়ে ট্রেন ধরে অফিসে যেতে হয়। ফিরতে ফিরতে রাত ৭-৮টা বেজে যায়। এসে আবার নিজের কাজ নিজেই করতে হয়। ঢাকার বাসার সেই গৃহকর্মী খুব মিস করি।’
দেশে ফেরা নিয়ে তিন্নি বলেন, “অনেক দিন তো হলো আসা। এরই মধ্যে এখানকার নাগরিকত্বও পেয়েছি। ইচ্ছা আছে সুবিধাজনক সময় দেখে দেশে যাওয়ার। দেখা যাক।”
বিদেশে গিয়ে আর বিনোদন অঙ্গনে কাজ করা হয়নি তিন্নির। তবে বিদেশের মাটিতে বসে দেশের প্রিয় সহকর্মীদের নাটক, ওয়েব সিরিজ, ফিল্ম দেখা হয় তার। অভিনেত্রী বলেন, “ব্যাচেলর পয়েন্ট নাটকটি খুব মজা করে দেখেছি। অপূর্ব, নিশোর নাটক দেখা হয়।”
এ ছাড়া ওটিটিতে ‘কারাগার’, ‘মহানগর’, ‘ফ্লোর নম্বর ৭’ সিরিজগুলো দেখা হয়েছে। ‘কারাগার’-এ চঞ্চলের অভিনয় অস্থির। একসময় যাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাদের এসব কাজ দেখে ফেলে আসা দিনগুলো মিস করেন। সহশিল্পী, দর্শক ও ভক্ত সবার কথা মনে করে মন কাঁদে বলে জানালেন তিন্নি।
এই অভিনেত্রী বলেন, “যখন সবার অভিনয় দেখি, ভাবি সবাই আছে আমি নেই। এভাবে তো আমার আরও অনেক দিন কাজ করার কথা ছিল। তাদের অভিনয় দেখতে দেখতে মনের অজান্তেই কখনো কখনো কল্পনায় বাংলাদেশে ক্যামেরার সামনে যেন চলে যাই আমি। দীর্ঘ সময় সবার সঙ্গে কাজ করেছি। সম্পর্কটা পরিবারের মতোই গড়ে উঠেছিল, সবার মধ্যে কী সুন্দর আন্তরিকতা ছিল। দর্শক ও ভক্তদের কথা খুব মনে পড়ে, মন কাঁদে।”
বেড়ে ওঠা শহর ঢাকার কথা মনে করে তিন্নি আরও বলেন, এখানে তো রিকশা নেই। রিকশায় চড়ে ঢাকা শহর ঘোরা, ঢাকার রাস্তায় ফুচকা খাওয়াটা মিস করি।
সহকর্মীদের অনেকেই বলেন, তিন্নির এ অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। ২০০৬ সালের কথা, ছোটপর্দায় আলোচনার তুঙ্গে তিন্নি। ভালোবেসে সহশিল্পী হিল্লোলকে বিয়ে করেন এ অভিনেত্রী। একটা সময় তাদের ঘরে আসে মেয়ে ওয়ারিশা। অভিনয়, সংসার, সন্তান নিয়ে ভালো চলছিল তার।
জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ২০১০ সালে সোহানুর রহমান সোহান তার ‘সে আমার মন কেড়েছে’ ছবিতে তিন্নিকে শাকিব খানের বিপরীতে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দেন। তার আগে থেকেই ঢালিউডে নতুন নায়ক-নায়িকা উপহার দেওয়ার একটা সুনাম ছিল সোহানের। বলতেই রাজি হয়ে গেলেন তিন্নি।
অভিনেত্রী বলেন, ‘সোহানুর রহমান সোহানকে আমি প্রথম দিনের মিটিং থেকেই বাবা বলে সম্বোধন করতাম। উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় মিটিং হলো। গল্প পছন্দ হলো। আমাকে সোহান বাবা বললেন, তুমি ছোটপর্দায় অনেক জনপ্রিয়। শাকিবও বড়পর্দায় জনপ্রিয়। সুতরাং দুজনকে ভালো মানাবে। তোমার চরিত্রটা সেভাবেই গল্পে রাখা হবে, চিন্তার কিছু নেই। আর তুমি প্রযোজকের আর্টিস্ট না, পরিচালকের। মাথা উঁচু করে কাজ করবে। তখন পারিপার্শ্বিকতার কারণে বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয়ের বিষয়ে অনেকে নাক সিটকাতেন। বিষয়টি নিয়ে আমিও চিন্তায় ছিলাম। যাই হোক সোহান বাবার ওপর ভরসা করেই কাজ শুরু করলাম।
জনপ্রিয় এই মডেল বলেন, ‘ছবির শুটিংয়ের আগে শাকিব খানের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হলেও ওভাবে কথা হতো না। শাকিবের সঙ্গে প্রথম কাজ, চিন্তায় পড়লাম, কতটুকু সহজ হবে কাজ। কারণ আমি ছোটপর্দা থেকে এসেছি। প্রথম দিন আমাদের দুজনের গানের শুটিং ছিল। কিন্তু শুটিং করতে গিয়ে মনে হয়েছিল, শাকিব অনেক দিনের চেনাজানা আমার। ফলে কাজের প্রথম দিনই বুঝে গিয়েছিলাম, সমস্যা হবে না। ভালো কাজ করা যাবে।
তিন্নি বলেন, শাকিব খানকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার অন্য রকমের ভালো লাগার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার একদিনও মনে হয়নি আমি ছোটপর্দার শিল্পী। তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ ছিলাম। তিনি সবসময় নিম্ন স্বরে কথা বলতেন। কাজের সময় যথেষ্ট আন্তরিক মনে হয়েছে তাকে।
২০১২ সালে প্রথম ছবি মুক্তির পর বেশ আলোচনা তৈরি হয় তিন্নিকে ঘিরে। বেশ কয়েকজন পরিচালক তাকে নিয়ে কাজের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ওই সময়ই হিল্লোলের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিন্নির অনিয়ন্ত্রিত জীবন শুরু হয়। আস্তে আস্তে কাজ থেকে ছিটকে যেতে থাকেন তিনি।
তিন্নি বলেন, ওই সময়ে হিল্লোলের সঙ্গে বিচ্ছেদসহ কিছু কারণে ভালোভাবে আর কাজে মনোযোগ দিতে পারিনি। কিছু কাজের ব্যাপারে আমার নিজেরও কিছুটা দোষ ছিল। ফলে আমাকে পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল।