• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য ইলিয়াস কাঞ্চনের


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৪, ১২:২২ পিএম
শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য ইলিয়াস কাঞ্চনের
চিত্রনায়ক ও চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপাতি ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবি: সংগৃহীত

নির্বাচন সামনে রেখে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি নিয়ে বোমা ফাটালেন চিত্রনায়ক ও চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ভেতরের নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরেন।  সম্প্রতি সংগঠনটির বনভোজনে এই অভিনয়শিল্পী জানান, তিনি দুঃখ নিয়ে সমিতি থেকে বিদায় নিচ্ছেন। 
কী দুঃখ নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে জানালেন জনপ্রিয় এই নায়ক। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন,  “সত্যি বলতে, আমি তো আসলে শিল্পী সমিতির নির্বাচন করতেই চাইনি। অনেক অনুরোধের পর আমি সিদ্ধান্ত নিই। সাধারণত আমি যে দায়িত্ব নিই, সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের চেষ্টা করি। যেমন আমার জীবনে অনেক ছবিতে কাজ করেছি, শুটিংয়ের আগে জেনেছি, এসব ছবি চলবে না। তারপরও সেসব ছবিতে অভিনয় খারাপ করিনি।”

তিনি আরও বলেন, “আমি চিন্তা করতাম, ছবিটা খারাপ হলেও আমার অভিনয় খারাপ হয়েছে, এমনটা যেন কেউ না বলেন। মানুষ হিসেবে আমি আসলে এমনই ভাবনাচিন্তা নিয়ে চলি। আমি কিন্তু এর আগে শিল্পী সমিতির সেক্রেটারি ছিলাম। এই সমিতি প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সেক্রেটারি ছিলেন আহমেদ শরীফ, এরপর আমি ছিলাম। সেই সময় নির্বাচন করার জন্য যে কষ্ট করতে হয়েছে, সেটাও ভালো লাগেনি।

ভালো লাগেনি বলতে, একটা ভালো অবস্থানে থাকার পরও শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে পরে আর আগ্রহ দেখাইনি। আমি মনে করি যে মানুষ সৎ নাকি অসৎ, ওয়াদা করলে রাখে নাকি রাখে না—এটা কিন্তু সবারই কমবেশি জানা। এই জানাজানির পরও বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভোট চাওয়ার যে পদ্ধতি, এটা ভালো লাগেনি। সব সময়ই চিন্তা করেছি, শিল্পী সমিতির সদস্য যাঁরা, তাঁরা যেন অবশ্যই পেশাদার ও প্রকৃত শিল্পী হন। কিন্তু শিল্পী সমিতি এবার চালাতে গিয়ে দেখলাম, এখানে মোটেও তা নেই। কারও প্রধান পরিচয় পরিচালক, কিন্তু তিনি অভিনয় করেন।

আবার কেউ নাচের, তাদের আবার নিজেদের সংগঠনও আছে, কেউ আবার ফাইটার, তাদেরও আছে নিজস্ব সংগঠন—এঁদের সবারই শিল্পী পরিচয়টা তাঁর দ্বিতীয়। তারা সবাই শিল্পী সমিতির পূর্ণ সদস্য হয়ে বসে আছেন। অথচ এই শিল্পী সমিতিতে আমাদের সময়ে নিয়ম, ১০ গুরুত্বপূর্ণ ছবির চরিত্রে অভিনয় করলেই সদস্যপদ পাওয়া যাবে। কিন্তু গত কয়েক টার্মে এসব নিয়ম পুরোপুরি পাল্টে গেছে। নিয়ম না মেনে অনেকে সদস্য হয়েছেন। শুধু ভোটের কারণে এমনটা ঘটেছে। তাই এসব নিয়ে সব সময় জটিলতা লেগেই থাকত। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিতে ছয় শতাধিক শিল্পী! এটা ভাবা যায়! তা-ও প্রকৃত শিল্পী! সক্রিয় শিল্পী। সত্যি বলতে, এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। আমাদেরও নিয়মনীতি আছে।

আমাদের শিল্পী সমিতির সঙ্গে অন্য যেসব ব্যাপার আছে, যেমন জুনিয়র শিল্পী, নাচের শিল্পী, ফাইটারদের নিজস্ব সমিতি আছে। তাই তারা আমাদের সমিতিতে সহযোগী হিসেবে থাকতে পারেন। ভোটাধিকার পাবেন না। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে এমন অনিয়ম চলছে। প্রকৃত শিল্পী কম থাকায় শিল্পী সমিতিতে ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন নাচের সমিতি, ফাইটার সমিতির লোকজন। ওদের সংখ্যাই বেশি। প্রকৃত শিল্পীরা একরকম মাইনরিটি। এবার নির্বাচন করলাম, এর আগে নির্বাচন কমিশনার ছিল। তখনো আমার কানে এসেছে, শিল্পী সমিতির নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি হয়। এই নির্বাচনেও টাকার ছড়াছড়ি হয়েছে, আমি তো নিজের চোখে দেখলাম।


টাকার ছড়াছড়ি কেন, এমন প্রশ্নে নায়ক বলেন, “আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল। যিনি শোনেন তিনিই বলেন, শিল্পী সমিতির নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি কেন হবে? কেন এখানে টাকা দিয়ে ভোট কিনতে হবে। এই সমিতির পদ-পদবি ভিন্ন উপায়ে আয়রোজগার করার সিস্টেম। তাই নির্বাচনে জিততে প্রকৃত শিল্পীদের বাইরে সবাই মরিয়া হয়ে ওঠেন।’

নির্বাচন ঘিরে টাকার ছড়াছড়ি হওয়ার কারণ হিসেবে বরেণ্য এই অভিনেতা বলেন, “টাকার ছড়াছড়ি হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, নাম উল্লেখ না করেই বলছি, কিছু মানুষ এখানে আছেন, যাঁরা নির্বাচন করতে চান, তাঁদের টাকা আছে। টাকা থাকলেও তাঁদের বেশির ভাগ প্রকৃত শিল্পী হতে পারেননি। শুধু শিল্পী সমিতির সদস্য হওয়ার কারণে, সুধী সমাজ বলি বা সমাজের ভালো জায়গা বলি, অবলীলায় তারা যেতে পারেন। শুধু শিল্পী সমিতির সাইনবোর্ডটা থাকলে সুবিধা হয়। পদ-পদবির কারণে অনেক ভালো ভালো জায়গায় যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। তাঁরাও দেখা গেছে, শিল্পী সমিতির পদ-পদবির কারণে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, বসে আড্ডা দিতে পারছেন; অথচ চলচ্চিত্রে তাঁদের কোনো ভ্যালু নেই। কারণ, তাঁদের সেই অর্থে ছবি নেই। কেউ তো আবার ঠিকমতো অভিনয়টাও জানেন না। শুধু কৌশল খাটিয়ে, টাকাপয়সা খরচ করে শিল্পী সমিতিতে সদস্যপদ হয়ে সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।

সত্যি বলতে, তারা মোটেও প্রকৃত শিল্পী হতে পারেননি। তাই সমিতির মাধ্যমে প্রকৃত শিল্পীদের প্রতিনিধি হয়ে নিজেদের বিশাল কিছু মনে করা শুরু করেন। পদাধিকারবলে সুধী সমাজের নানা দাওয়াতে জায়গা করে নেন। প্রকৃত শিল্পীর বাইরে ওই সংখ্যাও অধিক। সংখ্যায় যারা অধিক, তাঁরা নির্বাচনে যেসব প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাদের সবার কাছ থেকে টাকা নেন। এক রকম প্রতারণাও করেন। যাঁরা প্রকৃত শিল্পী, শুধু তাদের ভোটাধিকার থাকলে এ ধরনের সমস্যা হতো না। আমার কথা হচ্ছে, অন্যরা সহযোগী হিসেবে থাকুন, কিন্তু ভোটাধিকার না থাকলে নির্বাচন ঘিরে এত আওয়াজও হতো না। সহযোগী শিল্পীরা সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন, শুধু ভোট দিতে পারবেন না। এবারের পিকনিকে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে, মেয়েরা মেয়েরা দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়েছেন। এসব ঘটনা যেখানে ঘটে, সেখানে তো সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিতে আমি রাজি নই। আমাকে নিয়েও দেখলাম এমন সব সদস্য কথা বলেছেন, যা কোনো দিন বলার কথা নয়। এসব সমিতির এখনকার অবস্থার কারণে সম্ভব হয়েছে। এখানে ঈদের সময় এলে সহযোগী সদস্যদের অনেককে টাকাপয়সা দিতে হয়। এবারও হয়েছে। কিন্তু আমি এসব সমর্থন করিনি। কারণ, আমি নির্বাচন করব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই দিইনি। অন্যরা তো করবেন, তারা ঠিকই দিয়েছেন। এসব বজায় রেখেছেন।

কখন থেকে এসব শুরু হয়েছে? কাঞ্চনের সহজ উত্তর, যা বুঝলাম, বেশ অনেক দিন থেকে শুরু হয়েছে। এসব মোটেই কাম্য নয়। আমি দেখলাম, এমন অনেকেও টাকা নিয়েছেন, যাদের টাকার প্রয়োজন নেই। এমন একজনকে ডেকে বলেছি, ‘তুমি যে টাকাটা নিতে আসছ, এটা তো তোমার দরকারও নেই। তোমার আয়ও আছে। কাজও করছ। না নিলেও পারো। তুমি চাইলে শিল্পী সমিতিতে তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা রাখতে পারো, যাতে সত্যিকারের সহযোগিতা যার দরকার, তার কাজে আসবে।’ এ কথা বলার পর ড্যান্সের সেই ছেলে কোনো কথা নেই বার্তা নেই, ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়া তো এখন হাতের মুঠোয়। এখানে কোনো রেস্ট্রিকশন নেই। আমার সম্পর্কে নানা কিছু লিখেছে! আমি এসবের প্রতিবাদ করিওনি অবশ্য। কয়েক দিন আগে এ-ও শুনলাম, একটা মেয়ে বলছে, শিল্পী সমিতি তো এখন বন্ধই থাকে।

নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি হয়। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে একেকটা প্যানেলের আসলে কত টাকা খরচ হয়? এবার সোজাসোজি উত্তর দিলেন, ‘একেকটা প্যানেলের ৮০-৯০ লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত টাকা কেন খরচ হবে এমন একটি নির্বাচনে। কী এমন আছে এই সংগঠনে, আমি বুঝি না।’


সহযোগী শিল্পীদের ভোটাধিকার না থাকার কথা বলছিলেন, এ ক্ষেত্রে তা কার্যকর করায় বাধা কোথায়? ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “শিল্পী সমিতিতে এমনও ভোটার আছেন, যাদের আমিও চিনি না, অন্য অনেকেও চেনেন না। অথচ তাঁরা শিল্পী সমিতির পূর্ণ সদস্য। ভোট প্রদান করেন, নির্বাচনও করেন। আর এ কারণে সিনিয়র শিল্পী ও প্রকৃত শিল্পীরাও সমিতিতে আসতে চান না। আসলে একবার যদি পূর্ণ সদস্য দিয়ে দেওয়া হয়, তখন বাদ দেওয়াটা মুশকিল।”

কিন্তু পূর্ণ সদস্য দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি অনিয়ম ঘটে...
এটা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এই শিল্পী সমিতি ঘিরে এমনও দেখেছি, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, যা মোটেও কাম্য নয়।  

গত দুই বছরে মিটিংয়ে এসব নিয়ে বলেছিলেন? অনেকবার বলেছি। আমি থাকা অবস্থায় যেসব শিল্পীর সদস্যপদ দিয়েছি, তারা প্রকৃত অর্থেই শিল্পী। টেলিভিশন নাটকে বেশ কয়েকজন শিল্পী আছেন, তারা চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করছেন, নানা কারণে তারা এখানে সদস্যপদ নিতে আগ্রহী হন না। তাদের একরকম ডেকে এনে সদস্যপদ দিয়েছি। বলেছি, ‘আপনার আসেন।’  


প্রকৃত শিল্পীর বাইরে কি পরিমাণ সদস্য এখানে আছে, এমন প্রশ্নে জানিয়েছেন, ‘দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। আমার কথা হচ্ছে, তারা থাকুন। সহযোগী হয়েই হোক। ভোটাধিকার না থাকুক। শুধু ভোটাধিকার থাকার কারণে নির্বাচনের সময়ে এরা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ভোটের সময় তাদের সবাইকে টাকা দেওয়া হয়। সব পক্ষের কাছ থেকে তারা টাকা নেন। ভালো অংকের টাকা নেন। আমি আসলে সংখ্যাটা উল্লেখ করতে পারব না। আমি দূরে থাকতে চাই। আমি যখন এসব নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম, তখন এসব থেকে আমাকে অন্যরা দূরে রাখা শুরু করেন। আমিও এসব নিয়ে তাই আর মাথা ঘামাতে চাই না।


সমিতির প্রতি আগ্রহ আসলে কোন ধরনের শিল্পী-কলাকুশলীর, এর ইত্তরে চির সবুজ এই নায়ক বলেন, “সেই অর্থে যাদের কাজ নেই, সহযোগী সদস্য যাদের হওয়ার কথা, তাদের আগ্রহটা বেশি। প্রচণ্ড রকম বেশি। এই সংগঠন তাদের প্রধান পরিচয়। প্রকৃত শিল্পীদের আগ্রহ সহযোগীদের চেয়ে অনেক কম। প্রকৃত শিল্পীদের তো সমিতির পরিচয় লাগে না। তাদের এমনিতেই সবাই চেনেন, একনামেই জানেন। সমিতি বরং প্রকৃত শিল্পীদের কারণে আলোকিত-আলোচিত হয়।”

Link copied!