• ঢাকা
  • বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

বাংলা গানের যিনি ‘হেমন্ত’


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০২৩, ১১:২৬ এএম
বাংলা গানের যিনি ‘হেমন্ত’

কবীর সুমনকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক যন্ত্রণার কথা বলেছিলেন, “টুটুল (সুমনের ডাকনাম), বড় কষ্ট রে, যেখানেই গাইতে যাই সেই ‘রানার’ আর ‘পাল্কির গান’-ই গাইতে হয়।” এ যন্ত্রণাটার কথা নিয়ে খুব একটা শোনা যায় না। সার্থক জনপ্রিয় শিল্পীদের এই সমস্যাটা চিরকালীন। শ্রোতা তৈরি করতে গিয়ে নিজের গানটা গাইবার সুযোগ মেলে কম। এই অতৃপ্তি বাদ দিলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যা পেয়েছেন এবং যা দিয়েছেন সেখানে কোনোকিছুর তুলনা চলে না।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কিন্তু গান গাইবার কথাই ছিল না। তিনি ভাবতেন আট দশটা বাঙালির মতো চাকরি করবেন। গানের গুরু/ওস্তাদ কেউ ছিল না। শুনে শুনে গুনগুনিয়ে শেখা। স্কুলে কেউ ওনাকে গান গাইতে দেখেনি, ডাকেওনি কোনো প্রতিযোগিতায়। ওনার বন্ধু ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তিনি বলেন, ‘চল তোকে রেডিওতে গাওয়াবো।’ তিনি অডিশন দিয়ে পাশ করলেন। বাসা থেকে গান বাজনায় তেমন সায় নেই। তবুও গাইলেন। সেই থেকে শুরু। তারপর স্কুল পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলেন। কিন্তু তার তো গানের নেশা। গ্রামোফোনে রেকর্ড বের করবেন। কিন্তু শিল্পী ও গুণীজনরা তেমন আগ্রহ দেখান না। পরে ভাগ্যের সহায়তায় ওনার রেকর্ড বের হলো। চলতো মোটামুটি। তিনি পড়াটা ছেড়ে দিলেন। ভাবলেন গান বাজনা করবেন আর একটা ক্লার্ক টার্কের চাকরি করবেন। এ জন্য তিনি শর্টহ্যান্ডও শিখলেন। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র তখন দাঁড়াচ্ছে, তিনি সিনেমার সংগীত পরিচালনার কাজ শুরু করলেন। অনেক কাজ তখন তার, ভীষণ ব্যস্ত। নতুন নতুন জায়গায় নিজেকে প্রমাণ করতে মরিয়া হতেন। যেমন তিনি রবীন্দ্রনাথের গান পারতেন না। শিখে তৈরি হয়ে ১৯৪৪ সাল থেকে গাওয়া শুরু করেন। হেমন্তের রবীন্দ্র সংগীত একটু বেশী মাধুর্যময়। এমন নিখুঁত ব্যারিটোন ভয়েস পংকজ মল্লিক ছাড়া আর কারো ছিল না।

পঞ্চাশের শুরুতে তার বোম্বের হিন্দি ছবিতে কাজ শুরু। ‘আনন্দমঠ’ সিনেমায় সংগীত পরিচালক হলেন। তারপর থেকেই বোম্বের অন্যতম ব্যস্ত শিল্পী ও সংগীত পরিচালক। তখনও তিনি বাংলা গানটাও ছাড়েননি। একাধারে সব গাইছেন। ভুপেন হাজারিকার কাছ থেকে শেখা অসমীয়া ভাষার গান, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, অসংখ্য ভাষার গান গাচ্ছেন। টাকা জমিয়ে ছবিও প্রযোজনা করছেন। লতা মুঙ্গেশকরকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ানো লোকদের সারিতে তিনিও ছিলেন। একটা হিন্দি ছবিতে অর্থলগ্নি করে বিপদেও পড়েন। তবুও তার প্রযোজনার উদ্দীপনা আর গান গাওয়ার প্রতি নিবেদন ছিল অতুলনীয়। প্রচুর জায়গায় গান গাইতেন। ষাটের শেষে একটা সময় বুঝে যান হিন্দি মার্কেটে খাপ খাচ্ছেন না। তিনিও কলকাতার দিকে আবার সব গুটিয়ে নিয়ে চলে যান। গীতিকার গুলজারের একটা গল্প আছে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আবেগ আক্রান্ত হয়ে নাকি বলেছিলেন, ‘আর কবে না কবে দেখা হয়। তোমরা পারলে মনে রেখো।’

হেমন্তের ভেতর এক ধরনের পিতার মতো লিডারশিপ ছিল। তিনি সহশিল্পীদের খুব আদর ও শাসন করতেন। আবার তার ছিল সবার জন্য ভালোবাসা। গুরু দত্তের চলে যাওয়ার পর গীতা দত্ত খুবই ড্রাংক থাকতেন আবার তার টাকারও দরকার ভীষণ। দেখা যেত গীতা দত্তকে স্টেজে উঠিয়ে তিনি গোটা গানটা গেয়ে দিতেন। ইউটিউবে ভি বালসারার সঙ্গে হেমন্তের দু একটা ভিডিও পাওয়া যায়। দেখলে মনে হয় কি সুন্দর ও সহজ গানের ভুবন ছিল এদের। এখন অনেকে প্রশ্ন করে, এই সময়ে এসে হেমন্ত মান্না দে কীভাবে প্রাসঙ্গিক? আমার কাছে এর উত্তর, “আপনি প্রাসঙ্গিক রাখলেই প্রাসঙ্গিক, না রাখলে নাই।”

সকাল থেকেই আমি গাইছি, শুনছি, আউড়াচ্ছি একটা গানই। ‘জানে ও ক্যায়সে’ গানটা ‍‍`পিয়াসা‍‍` ছবির। শচীন কর্তার সুর, শাহির লুধিয়ানভীর লেখা। গানটা এত ভালো। আমার কাছে মনে হয় এই গান তো আমার জন্যই লেখা। আর অনেকেই জানে না গানটা শচীন কর্তা সুর করেছিল একদিন তার বাসার পাশের এক স্কুলে জাতীয় সংগীত গাচ্ছিলো ছেলেমেয়ে সেই রেশ থেকে। কেউ ভাবতে পারবে এমন। এসব নিয়ে চর্চা আমার জীবনে প্রাসঙ্গিক, অন্যদের ভুবনে নাও হতে পারে।

মনে রেখেছে তাকে সবাই। দেশে বিদেশে যেখানে গান গেয়েছেন তিনি মুগ্ধ করেছেন। বব মার্লের দেশ জ্যামাইকাতে গিয়েও অনেক পপুলার হন। তাকে দেখতে হাজারো মানুষ আসতো। সাধারণত তারা ভারতীয় হলেও এরকম ভারতীয় শিল্পী দেখে নাই আগে। মোটামুটি উন্মাদনা হতো তাকে নিয়ে। আমেরিকা ইউরোপ হয়ে ইন্দোনেশিয়া জাপান সব খানেই পেয়েছেন অকুণ্ঠ ভালোবাসা। কেউ কেউ বলতো, প্রাচ্যের ‘ফ্রাংক সিনাট্রা’।

হেমন্তের অসংখ্য গান। কোন গানের কথা বলবো! ও নদীরে, অলির কথা বকুল হাসে, অবাক পৃথিবী, নীল আকাশের নীচে, এই রাত তোমার আমার, নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আয় খুকু আয়, এই মেঘলা দিনে একলা, বলে শেষ করা যাবে না। হিন্দি গানের সংখ্যাও অনেক। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো। অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন, সবচেয়ে বড় পুরষ্কার তো পেয়েছেন যুগের পর যুগ মানুষের  ভালোবাসা। ইউটিউবে আপনি হাজার হাজার ওনার গানের ‘কাভার’ পাবেন। অসংখ্য শিল্পী শুধু তার গান গেয়েই জীবিকা নির্বাহ করছে। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে অবদান। বিটিভির রজতজয়ন্তীতে সম্ভবত এসে গেয়েছিলেন, আর্কাইভে দেখাতো আগে। হেমন্ত বেঁচে থাকবেন আরও অনেকদিন। জন্মশতবর্ষ পেরিয়েও তাকে স্মরণ করবে সবাই। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাংলা গানের এ কিংবদন্তীকে।

Link copied!