শিল্পীদের সব সময় নিরপেক্ষ থাকার কথা বলেছেন শিল্পীসমাজ । তারা মনে করেন একজন শিল্পীর কখনই দলীয় ব্যানারে কাজ করা উচিত নয়। কেননা, একজন শিল্পীর অনেক ফ্যান ফলোয়াড় থাকে, তাদের অনেকে ফলো করেন। যে কারণে তাদের নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানান।
শনিবার (১০ আগস্ট) বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক নতুন এক দেশের আহ্বানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সমাবেশের ডাক দেয় দৃশ্যমাধ্যম শিল্পী সমাজ, আলোকিচিত্রী সমাজ, বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীরা, বাংলাদেশ সংগীতশিল্পী সমাজ (গেটআপ স্ট্যান্ডআপ) সংগঠনগুলো।
এসময় স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে সবাইকে বিপ্লবী অভিনন্দন জানান। পাশাপাশি রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ছাত্রদের পাশে থেকে সর্বজনের প্রতিনিধিত্বমূলক বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেন। দেশের অভ্যন্তরে চলমান সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ সর্বস্তরের শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী গভীরভাবে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন কথাও বলা হয়।
এসময় শিল্পীদের দলীয় ব্যনারের হয়ে কাজ করা বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা প্রশ্ন করেন আগত শিল্পীদের। বিষয়ে নিয়ে নিজের অবস্থা পরিস্কার করে অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম।
তিনি বলেন, শিল্পীরা যে যার মতো করে তাদের মতামত পরিস্কার করতে চাচ্ছেন এবং তাদের কথা গুলো যেন স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারেন। আমরা স্বাধীন দেশ চেয়েছি। আর সেই স্বাধীনতা যখন আমরা পাবো, কাজের স্বাধীনতা যখন আমরা পাবো তখনি ছাত্রদের এই রক্তের এই প্রাণের বিসর্জনের মূল্যায়ন আমরা করতে পারবো।
শিল্পী সমাজের মধ্যে বিভক্তি কেন জানতে চাইলে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘বিভক্তি সকলের মধ্যেই আছে, আপনাদের (গণমাধ্যম) মধ্যেও আছে। আন্দোলনের সময় অনেকে বিভক্তিতে পরেছেন। যার যার অবস্থান প্রত্যেকে পরিস্কার করবেন। আমি আমার অবস্থান পরিস্কার করেছি। আপনারাও আপনাদের অবস্থান পরিস্কার করবেন বলে আমি আশা করছি।’
শিল্পীরা কখনই দলীয় হতে পারে না মন্তব্য করে অভিনেত্রী নাজিয়া হক অর্ষা বলেন, ‘তাদের অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে হবে। সরকার আসতে পারে, যেতে পারে, চিন্তা চেতনার মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু শিল্পীরা সবসময় নিরপেক্ষ থাকা উচিত। যেটা ন্যায়, সেটা পক্ষে থাকা উচিত। যেটা অন্যায় সেটাও পক্ষে থাকা উচিত, ন্যায় অন্যায় মিলিয়ে কথা বলা উচিত। আমি ন্যায়কে ন্যায় বলতে পারি আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘শিল্পীদের সবার আগেই সেই ভয়েজটা রেইচ করা উচিত কারণ, একেক জন শিল্পীকে হাজার হাজার মানুষ ফলো করে। আমি যদি একটা কথা বলে আমাকে সচেতন হতে হবে আমার শব্দের ব্যপারে এবং আমার মনোভাবে ব্যাপরেও আমাকে সচেতন হতে হবে। সুতরাং আমাদের মনে হয় শিল্পীদের অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকা উচিত।’
নাজিয়া হক অর্ষা বলেন, শিল্পীদের মধ্যে নানা বৈষম্যতা ছিলো, এই বিষয়টা যেন আর না থাকে, একত্রিত থেকে কিভাবে স্বাধীনাভাবে কাজ করা যায়, এর আগে অনেক সিন্ডিকেটের শিকার হয়েছি। যে যোগ্য সে অনেক দিন কাজ পায়নি, ভিউয়ের একটা টানা পোড়েন ছিলো। এই জিসিস গুলোকে কাটিয়ে উঠে আরও প্রোপার ওয়েতে কাজ করতে চাই এবং যে যে কাজটার জন্য সে যেন সে কাজটা পায়, একজন ডিরেক্টের যেন ফ্রি উইল থাকে কাজের ক্ষেত্রে এগুলোই বলা আমাদের যায়গা থেকে এখন বাকিটা চেষ্টা করতে হবে।
অভিনেত্রী সাবেরী আলম বলেন, ‘ছাত্রদের কাছে এতো কিছু শেখার আছে আগে কখনও জানতাম না, আমরা সবসময় মনে করেছিলাম যে ওরা ছোট, এখন ওরাই আমাদের পথ দেখিয়ে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং ওদেরকে দেখে আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, দেশপ্রেম শুধু কথার মাধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে কাজে প্রমাণ করা। এই শিক্ষাটা যদি আমরা শিখে এপ্লাই করতে পারি, তাহলে খুব ভালো হয়, সবাই সবার যায়গা থেকে চেষ্টা করলে ছোট ছোট একটা উদ্যোগ থেকে অনেক বড় ভালো কিছু হবে। যেকোন বৈষম্যের উর্ধে যেন আমরা উঠতে পারি এবং দেশ প্রেম যেন সঠিক যায়গা চর্চা হয়েছে সেটা যেন ধরে রাখতে পারি। ’
তিনি আরো বলেন,‘এখন পর্যন্ত সবতো ভালো হচ্ছে কেন মন্দটা আশা করবো। সব ভালো কিছু হবে। ওনাদের (অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার) কাছে প্রত্যাশার চেয়ে আমাদের শিল্পীদের কাছে প্রত্যাশা যে আমরা ধৈর্য্য এবং সহনশীল হই। কোন পরিবর্তনই রাতারাতি হয় না, আপনি আপনার যায়গা থেকে সৎভাবে কাজ করবেন, আমি আমার যায়গা থেকে আমার কাজটি সৎভাবে করবো তাহলে একটা ভালো যায়গায় পৌছাতে পারবো।’
শিল্পীদের দুটি পক্ষ নেওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে অভিনেত্রী ও উপস্থাপিকা নীল হুরেজাহান বলেন, ‘বিষয়টি খুবই ক্লিয়ার, ছাত্রদের পুলিশ গুলি করেছে, এরপরে যাদের বিবেক আছে তারা সবাই এর বিরুদ্ধে কথা বলেছে, যারা এর বিরুদ্ধে কথা না বলে বিভিন্ন ভাবে সেটাকে সাপোর্ট করেছে তাদের বিষয়টা ভাবা উচিত ছিলো। আমরা তাদের কাছে আরও ভালো কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম। তারা আমাদের সঠিক পথ দেখাবে এমন প্রত্যাশি ছিল। ’
সবাইকে পজেটিভ হওয়ায় আহ্বান জানিয়ে অভিনেত্রী সাফা কবির বলেন, ‘আমাদের উচিত একজন আরেক জনে পাশে এসে দাঁড়ানো, আমাদের দায়িত্বটা তাদের বুঝিয়ে বলা। আমরা যদি অন্যায় করি তার বিরুদ্ধে অন্যদের নিয়ে আসা’।
মডেল ও অভিনেত্রী সায়রা আক্তার জাহান, ‘আমি খুব অবাক হচ্ছি যে যখন সারা বাংলাদেশে ছাত্রেদের দাবি নিয়ে কথা বলে হচ্ছে তখন দুই ধরণের দল গঠন হয়েছিলো, একদল পক্ষে ছিলো আগের দল বিপক্ষে ছিলো, এটা খুবই অপ্রত্যাশিত, কিন্তু আশা করবো এটা আমাদের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে, যারা যখনই অধিকার আদায়ে কথা উঠেছে তারা তখনই মানুষের পাশে ছিলো। যারা বিপক্ষে কথা বলেছে তাদের কোন যুক্তি ছিলো তবে আমাদের যুক্তি ঠিক ছিল।’
অনেকে আত্নগোপনে আছে তাদেরকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে এই অভিনেত্রী আরও বলেন, প্রত্যেকের মানুষের কোন কোন আলাদা মতাদর্শ থাকে, তাদের সেই আদর্শকে সম্মান করা উচিত এবং সব সময় সেটা সঠিক সেই বিষয়টি নিয়ে যেন কথা বলে। কারণ যারা তারকা তারা যখন কোন কিছু বলে তখন অনেক মানুষ তাদের ফলো করে, অনেকে ইনফ্লোইন্স হয়, এই বিষয়টা মাথায় রেখে যার যার যায়গা থেকে জনগণের পাশে যেন এসে দাঁড়ায়।’
মডেল ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী আইরিন সুলতানা বলেন, ‘আমরা যখন কাঁধে কাধা মিলিয়ে কাজ করবো তখন কোন ভেদাবেদ থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি চাইনা কোন ভেদাবেদ থাকুক। আমি বলতে চাই শিল্পীরা সবাই এক এবং এক হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে চাই।’
শিল্পীদের বিভক্তির বিষয়টিকে একটা ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মডেল-অভিনেত্রী মুমতাহিনা টয়া। তিনি বলেন, ‘অনেকে অনেক কথা বলে চায় কিন্তু অনেক হুমকি ধামকি আসে, যে কারণে অনেকে বলে চেয়েও বলে পারেনি। কারণে অনেকে নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেছে, পরিবারে কথা চিন্তা করেছে হয়তো এজন্য বলেনি কিন্তু এরপর যখন বলেত আসছে, আমার মনে হয় তাদের বলে দেওয়া উচিত। একটা পর্যায়ে এসে আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি।’
তিনি বলেন, আমরা যারা শুরু থেকে কথা বলেছি ভবিষ্যতেও আমরা যাতে কথা বলতে পরি আমরা যাতে অনিরাপদ বোধ না করি। আমরা যদি কিছু একটা খারাপ লাগে সেটা যেন আমি বলতে পারি সেই বিষয়টাই চাই, ভবিষ্যতে যাতে কোন বাধা না আসে, আমি কারও ভয়ে কথা বলতে পারবো না এটা যাতে না হয়।’
তবে টয়া স্পষ্ট করে বলেছেন যে কোন শিল্পীর সাথে কোন রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ততা কোন ভাবে থাকা উচিত না, কারণ একটা দেশ গঠনে প্রত্যেক শিল্পীর এককেটা কথা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে হয়না এটা উচিত কোন রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ত হয়ে অন্য যারা ভিন্ন মত প্রকাশ করছে তাদের বিরুদ্ধে যাওয়া। আমরা দেখেছি অনেকে রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ত হয়ে অনেক সুবিধা নিয়েছেন এই বিষয়টা আমরা চাইনা। কাজের ক্ষেত্রে একেবারে অরাজনৈতিক মাঠ চাই।