জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগম। সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। সাবেক সংসদ সদস্য। এবার নির্বাচনে হেরে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। ভোটে অনিয়মের অভিযোগও তুলেছেন এই আলোচিত শিল্পী। তাকে নিয়ে এলাকায় এখন নানা আলোচনা। নির্বাচনে কেন পরাজিত হলেন তিনি। কেন দলীয় নেতাকর্মীরা দূরে সরে গেছেন। এসব বিষয় জানতে মমতাজ বেগমের নির্বাচনী এলাকা সিংগাইর ও হরিরামপুর ঘুরে পাওয়া গেছে নানা তথ্য। নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য ও মমতাজ বেগমের কর্মী- সমর্থকদের মধ্যেও আছে উত্তাপ ও উত্তেজনা।
এখনো দুই উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছেন মমতাজ।
কেউ বিরোধিতা করলেই নিজস্ব বাহিনী দিয়ে অত্যাচার নির্যাতন করেন এমন অভিযোগও আছে। সরকারি অফিস, হাটবাজার, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, মসজিদ- মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ সবই মমতাজের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে। কেউ চাঁদা তোলেন, কেউ আবার বালু ও ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। নদী ও আবাসন ব্যবসাও তাদের নিয়ন্ত্রণে। এই কাজে আইনি ও প্রশাসনিক সহায়তা করেন মমতাজ বেগম নিজেই। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ সবই মমতাজের হাতে। সব কমিটিতেই নিজের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের আধিক্য।
স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মমতাজ তার সৎ ছেলে আবু নাঈম বাশারকে পৌরসভার মেয়র বানিয়েছেন। মমতাজ নিজেই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার আপন ভাগিনা শহিদ একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সহ-সভাপতিও তার নিজের লোক। উপজেলা ছাত্রলীগের সহ- সভাপতি মমতাজের ছোট মেয়ে রাইসা রোজ ও নিজ ইউনিয়ন জয়মণ্টপ ছাত্রলীগের সভাপতি তার বড় ভাই এবারত হোসেনের ছেলে ফিরোজ কবির। তার এক সৎ বোন ইউপি সদস্য। সহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন মমতাজের পিএস জুয়েল ফকির, এপিএস সজল ও ওবায়দুর।
জানা গেছে, মমতাজকে নিয়ন্ত্রণ করেন তার ভাগিনা সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুর রহমান শহিদ ওরফে ভিপি শহিদ। এই শহিদের নেতৃত্বে একটি হেলমেট বাহিনী রয়েছে। উপজেলার মানুষ সেই বাহিনীর নাম দিয়েছেন ‘ভিপি বাহিনী’। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেন শহিদের ভাগ্নে ছাত্রলীগ নেতা ফাহিম বিজয়। ২০ থেকে ২৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে এই বাহিনীর সদস্যরা জয়মণ্টপ থেকে উপজেলা পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ান।
এই বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় মমতাজ বেগমকে নিয়মিত প্রটোকল দেন। ‘ভিপি বাহিনী’ পৌরসভার বিভিন্ন দোকানপাট, হাটবাজার, ইন্টারনেট, ক্যাবল, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ভ্রাম্যমাণ হকারদের জিম্মি করে চাঁদা আদায় করেন। কেউ চাঁদা না দিলে মারধর ও অত্যাচার নিয়মিত ঘটনা। মমতাজের সহায়তায় চাঁদাবাজি, জমি দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকা- করে কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন ভিপি শহিদ। পৌর সদরে করেছেন ৭ তলা বাড়ি। নিজের ও স্ত্রীর নামে সদরে প্রায় ৭০ শতাংশ জমি কিনেছেন। অথচ ৮ বছর আগেও এই শহিদের সংসার চলতো না।
গত কয়েক দিন সিংগাইর ও হরিরামপুর ঘুরে মমতাজ বেগম সম্পর্কে নানা তথ্য মিলেছে। জ্ঞাত, অজ্ঞাত নানা সম্পত্তি ও দখল, জবরদখলের তথ্য দিয়েছেন স্থানীয়রা। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মমতাজ। বলেছেন, তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এইসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।
মমতাজের যত সম্পদ: সিংগাইর জয়মণ্টপ বাসস্ট্যান্ড থেকে ২ কিলোমিটার দূরে হেমায়েতপুর-সিংগাইর- মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে পূর্ব ভাকুম মমতাজের নিজ গ্রাম। এখানে প্রায় ১৩০০ শতাংশ জমির উপর মমতাজ বেগমের বিরাট বাংলো বাড়ি আছে। ২০০৮ সালেও তার পৈতৃক জমি ছিল মাত্র ৪৮ শতাংশ। পরে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হওয়ার পরেই তিনি বাড়ির জমি বর্ধিত করতে থাকেন। চাপ দিয়ে আশপাশের জমি মালিকদের সব জমি কিনে নেন। এখন তার বাড়ির জমি ১৩ একর ছাড়িয়েছে। জমির মধ্যে মহাসড়কঘেঁষা ‘মধুর আড্ডা’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ও বৈঠকখানা করেছেন মমতাজ।
এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাউল শিল্পী আসলে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেন মমতাজ বেগম। এই ১৩ একর জমির মধ্যে মধু ও উজালা কোল্ড স্টোরেজ, মধুর মেলা, দোতলা বাড়ি, বাউল কমপ্লেক্স ও চার তলা ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছেন মমতাজ। স্থানীয়রা জানান, স্থাপনাসহ এই বাড়ি ও জমির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে মমতাজ বেগমের ঢাকায় কোনো বাড়ি ছিল না। ব্যবসা বলতে ছিল ৫ শতাংশ জমিতে ছোট পরিসরে টিনশেডের ছাপড়ার মধু উজালা কোল্ড স্টোরেজ নামে আলু হিমায়িতগার। ব্যাংকে সঞ্চয় ছিল ৩০ লাখ টাকা। বর্তমানে তার উত্তরা, মহাখালীতে দুটি ৬ তলা বাড়ি আছে। বাড়ি আছে কানাডাতেও। ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি, জমিসহ তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তার ৪টি গাড়ি রয়েছে। এরমধ্যে ল্যান্ড ক্রুজার ভি-৮ ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৭-৩৮৭৭। ল্যান্ড ক্রুজার ঢাকা মেট্রো-ঘ, ১২-১৪৭৮। টয়োটা হাইয়েস ঢাকা মেট্রো-চ, ১৫-৬১০৯। ফান কার্গো ঢাকা মেট্রো-খ, ১২-৫২৫২। তবে এমপি হওয়ার আগে ২০০৭ সালে তার কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না। এখন তিনি দেড় কোটি টাকার গাড়িতে চড়েন। পরিবারের সদস্যদের জন্যও আলাদা আলাদা গাড়ি রয়েছে।
গত পাঁচ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ২৮ গুণ। কমেছে ঋণের পরিমাণ। দুটি ফৌজদারি মামলার আসামিও তিনি। মামলা নং সি.আর-১২২ ও সি.আর-৩৬৪৪/২৩। ২০১৮ সালে তার বাৎসরিক আয় ছিল ৩৮ লাখ ৮৪ হাজার ২৭৬ টাকা। বর্তমানে তার আয় ৪৯ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৮ টাকা। সংসদ সদস্য ভাতা ও আনুষঙ্গিক পারিতোষিক বাবদ তিনি বছরে আয় করেন ১৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। তার মধু উজালা কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের ৩ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের শেয়ার আছে।
যে কারণে মমতাজের পরাজয়: সাম্প্রতিক সময়ে পুরনো নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে অনেকগুলো পকেট কমিটি করার অভিযোগ ওঠে মমতাজের বিরুদ্ধে। উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে কে কোন পদে থাকবেন, কাকে বাদ দেয়া হবে, কাকে নেয়া হবে, তা তিনিই ঠিক করে দেন। এতে অনেক ত্যাগী নেতারাই পদবঞ্চিত রয়ে গেছেন। ফলে নির্বাচনে হরিরামপুরে মমতাজ বেগম জয়লাভ করলেও শোচনীয় পরাজয় ঘটে তার নিজ উপজেলা সিংগাইরে। এই উপজেলার ৯ ইউনিয়নের ৮টির চেয়ারম্যানই তার বিরুদ্ধে ছিলেন। টিআর, উন্নয়ন প্রকল্পের বণ্টনে অনিয়ম ও পিএস জুয়েল ফকির, এপিএস সজল, ওবায়দুলের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ছিলেন চেয়ারম্যানরা। তাই সুযোগ বুঝে নির্বাচনে সকলে মিলে মমতাজ হটাও আন্দোলনে নেমে তাকে পরাজিত করেন।
মা-বোনদের সঙ্গে বিরোধ: মমতাজ বেগমের পিতা মধু বয়াতির প্রথম স্ত্রী এখনো জীবিত আছেন। তার রেহানা, জাহানারা ও শাহানা নামের ৩ কন্যা রয়েছে। মমতাজের মা উজালা বেগম মারা যাওয়ার পরে তাকে সৎ মা মনোয়ারা বেগমই লালন পালন করেন। তবে এমপি হওয়ার পরে তিনি সৎ মা ও বোনদের খোঁজখবর নেননি। এমনকি পিতার রেখে যাওয়া ৪৮ শতাংশ জমিও একাই দখলে রেখেছেন। এ নিয়ে সৎ মা ও বোনদের সঙ্গে বিরোধ চলছে। সৎ মা ও বোনদের মাত্র ৩ শতাংশ জমি দিয়েছেন। মমতাজ তার সৎ মায়ের খুপড়ি ঘরের সঙ্গে টিনের বাথরুম ও বোনের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের সঙ্গে পাকা বাথরুম দিয়ে রেখেছেন। বাউল মেলায় আগতরা এই বাথরুম ব্যবহার করেন। মমতাজের সৎ ৩ বোনের দুজন এখনো ভাড়া বাসায় থাকেন। ১০ বছরে কখনোই তাদের ভাগ্য বদলাতে আগ্রহ দেখাননি মমতাজ। এই ঘটনাও ভোটের মাঠে প্রভাব পড়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। মমতাজের সৎ মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ওর (মমতাজ) মধ্যে কোনো মনুষ্যত্বই নেই। আমাদের বসবাসের বাড়িটা মমতাজ টয়লেট বাড়ি বানিয়ে রেখেছে। শত্রুও এমন করে না। আমাগো ঘরের সঙ্গে জিদ করে ৮টি বাথরুম দিয়ে রাখছে। যাতে দুর্গদ্ধে আমরা থাকতে না পারি। আমার স্বামীর ৪৮ শতাংশ জমির মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ আমাদের দিছে বাকিটা একাই দখল করছে। আল্লাহ ওর বিচার করবে।
১০ পার্সেন্ট ভাগিনা শহিদ:সিংগাইরে মমতাজের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও হরিরামপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান মমতাজ বেগমকে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। সিংগাইর সদরে সরকারি-বেসরকারি অফিস মমতাজের ভাগিনা শহিদের দখলে। এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য, সড়ক ও জনপদ, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত, বিআরটিএ, বিদ্যুৎ অফিস, যুব উন্নয়ন অফিস, পল্লী উন্নয়ন অফিস, সাব- রেজিস্ট্রার অফিস, ভূমি অফিস, সমাজসেবা অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা, কৃষি, মৎস্য, প্রাণী ও খাদ্য বিষয়ক উপজেলা কৃষি অফিস, মৎস্য অফিস, উপজেলা খাদ্য, প্রাণিসম্পদ অফিস, ভূমি ও রাজস্ব বিষয়ক, উপজেলা ভূমি, উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক, উপজেলা সমাজসেবা অফিসের সব ধরনের কাজে শহিদকে ১০ শতাংশ চাঁদা দিতে হয় বলে আলোচনা আছে। চাঁদা না দিলে কাজে বাধা সৃষ্টি করা হয়। তবে এসব অফিস থেকে টাকা তোলেন জানাহারা বেগম। পরে সেই টাকা শহিদের কাছে জমা দেন। কোন খাতে কে চাঁদা আদায় করবে, সেটাও নির্ধারণ করে দেয়া আছে।
এলজিইডি দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর শিডিউল কিনতে পারলেও সেই দরপত্র কে জমা দেবে, সেটা শহিদ ঠিক করে দেন। কথা না শুনলে ভিপি বাহিনী পাঠিয়ে বাড়িতে হামলা করে দরপত্রের ক্রেতাকে তুলে আনা হয়। উপজেলার সব ঠিকাদারি কাজ হয় সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কমপক্ষে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত দরে। ২০১৫ সালের পর বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান একে একে দখল করে নেন তারা। প্রথমে দখল করেন উপজেলা বাস মালিক সমিতি। এরপর বাজার সমিতি, ক্রীড়া সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বালু মহাল, বাজার কমিটি, মসজিদ কমিটি, এমনকি সিংগাইর পাইলট স্কুল ও সরকারি কলেজের পরিচালনা কমিটির পদও তারা দখল করেন। মমতাজ বেগমের রাজনৈতিক সহযোগীদের অনেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে।
অধিকাংশের নামেই ডজনের উপরে মামলা রয়েছে। হরিরামপুর উপজেলা মমতাজ বেগমের সংসদীয় আসনে থাকলেও মূলত সেখানে তার তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তবে এই উপজেলায় তিনি বরাবরই বেশি ভোট পান। তাই এখানে উন্নয়ন কাজও বেশি হয়েছে বলে স্থানীয়রা মনে করেন। তবে সরজমিন সিংগাইর ঘুরে তেমন কোনো উন্নয়নের চিত্র চোখে পড়েনি। এখনো উপজেলা সদরের রাস্তাঘাট ভাঙাচুরা। উপজেলার প্রতিটি সরকারি অফিসই জীর্ণশীর্ণ। উপজেলা কমপ্লেক্স, থানা ভবন, ভূমি অফিস, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সবগুলোই পুরাতন ভাঙাচুরা ভবন। এতে সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ভোগান্তিতে আছেন।
পদ বাণিজ্য: বছর খানেক আগে একই দিনে সিংগাইর উপজেলা, পৌর ও কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি দেয় জেলা ছাত্রলীগ। মমতাজ বেগমের জবরদস্তি ও অভিপ্রায় অনুযায়ী তার পছন্দের ব্যক্তিদের নাম অনুমোদন করে কমিটি ঘোষণা করে জেলা ছাত্রলীগ। শাকিল আহমেদকে সভাপতি ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। অভিযোগ আছে সাধারণ সম্পাদক পদের বিপরীতে মমতাজের এপিএস সজল মামুনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন। সিংগাইর সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মহিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তৌশিকুর রহমান নজরুল। এই দুই নেতার কাছ থেকেও ৮ লাখ টাকা নিয়ে পদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। একই দিনে ১ বছরের জন্য সিংগাইর পৌর ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদন করা হয়। সাইফুল ইসলামকে সভাপতি ও টিপু সুলতানকে সাধারণ সম্পাদক করে এ কমিটির অনুমোদন করা হয়। এই দুজন মমতাজের সৎ ছেলে পৌর মেয়র আবু নাঈমের অনুসারী। তাদের দুজনের কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগ আছে। সিংগাইর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করা হয়। কমিটির সদস্য সচিব শাহিনুর রহমান শাহিন। এই পদের বিপরীতেও মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগ আছে।
চাঁদাবাজি: সিংগাইর উপজেলা খাদ্য গুদামের সামনের রাস্তার পাড় ধরে একটি অটোরিকশা ও সিএনজি স্ট্যান্ড আছে। সিএনজি প্রতি দৈনিক ৮০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। এই টাকা তুলে সালাম কমিশনারের ছেলে রকি আহমেদ। রকি মমতাজ বেগমকে লোকবল ও প্রটোকল দেন। এই স্পটে প্রায় ১০০টি সিএনজি অটোরিকশা আছে। সিংগাইর পাইলট স্কুলের মাঠ দখল করে সাপ্তাহিক হাট বসানো হয়। প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার এই হাট বসে। হাটের প্রতি দোকান থেকে ৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এই টাকা তোলেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিনুর রহমান শাহিন। হাটের কোণায় থানার সামনের রাস্তায় মাঠের প্রাচীর ঘেঁষে রাস্তার জমি দখল করে ৫ থেকে ৬টি ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো হয়েছে। প্রতিদিন দোকান প্রতি ১০০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়।
সিংগাইর শহীদ রফিক সেতুর নিচে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের জমি দখল করে নর্দান পাওয়ার প্ল্যান্টের কাছে বিক্রি করার অভিযোগ আছে মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে। ৪ বছর আগে এই জমি উদ্ধারে মামলা করে নদী রক্ষা কমিশন। পরে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিকরা। ২০২২ সালে মমতাজ বেগম কানাডার টরেন্টোতে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। ওই বাড়িতে তার যাতায়াত রয়েছে বলে স্থানীয় একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া জেলা পরিষদের বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করে নিজের বাড়ির বাউন্ডারি নির্মাণের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
বিয়ে: মমতাজের প্রথম স্বামী ছিলেন বাউল শিল্পী রশিদ বয়াতি। এরপর ২০০৭ সালে মানিকগঞ্জ পৌরসভা চেয়ারম্যান মো. রমজান আলীর সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। ২০১১ সালে তাকে তালাক দেন। পরে ২০১২ সালে মানিকগঞ্জ সদরের ‘মমতাজ চক্ষু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. মঈন হাসান চঞ্চলের সঙ্গে মমতাজ বেগমের তৃতীয় বিয়ে হয়। ৩ বছর ধরে মঈনের সঙ্গে বনিবনা নেই। তাকে মারধর ও মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে।
মমতাজ বেগমের বক্তব্য: তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আমাকে নিয়ে অনেক অপপ্রচার, মিথ্যা ছড়িয়েছে, এখনো ছড়াচ্ছে। এতে আমি মোটেও বিচলিত নই। কালো টাকা দিয়ে ভোট কেনা গেলেও মানুষের মন কেনা যায় না। তারা কালো টাকা দিয়ে আমার পরিবারের লোকজন ও চেয়ারম্যানদের কিনে নিয়েছে। এটা দেশবাসী দেখেছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু তারাই করে। কিন্তু জনগণের আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ অনুযোগ নেই। থাকলে তারা আমাকে এসে বলুক। আমি তা মাথা পেতে নেবো। উপজেলার কোনো কমিটিতেই আমার পরিবারের লোকজন নেই। যাদের যোগ্যতা আছে, তারাই পদ পেয়েছে। আর ভিপি শহিদ কোনো চাঁদাবাজ নন। তার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার সিংগাইরে কে আছে? তাদের বলতে বলেন তার রাজনীতির ধারে কাছে কেউ আছে কিনা। আমি সিংগাইর-হরিরামপুরের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করেছি। কোনো দখলবাজি, চাঁদাবাজি করিনি। আর দুই উপজেলা এখনো আমার নিয়ন্ত্রণে আছে। আমার নিয়ন্ত্রণ কেন চলে যাবে? প্রশ্নই আসে না। বুঝতে হবে, আমি নৌকার লোক।
সূত্র: মানবজমিন