সৌমিত্র বাবুর একটা গল্প আমরা জানি। এক চলচ্চিত্রের জন্য একটু ফ্ল্যামবয়েন্ট ধাঁচের হাতের লেখা লাগবে। ওনাকে সত্যজিৎ রায় টাস্ক দিলেন। কয়েক সপ্তাহের কসরতে ওনার লেখা এত সুন্দর হয়ে গেল যে কেউ ভাবতেই পারেনি। সামান্য গল্পই; কিন্তু গল্পটার মাধ্যমে আপনি সৌমিত্র বাবুর জীবন ‘সাম আপ’ করতে পারবেন। তিনি পরিশ্রমী, তিনি শিখতে আগ্রহী, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন। এটুক হলেই অনেক মানুষ সাফল্য পেয়ে যান। এইসব গুণের সঙ্গে ওনার ছিল, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও গুণীজনদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা। উনি এক অভিনেতাকেও এ পরামর্শ দিয়েছেন যে পড়াশোনা করা লোকদের সঙ্গে লাভের আশা ছাড়া মিশতে, তাহলেই হবে লাভ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সর্বভারতীয় স্টার হতে পারেনি। এটা নিয়ে অনেকের দুঃখ দেখি আজকাল। তিনি সর্বভারতীয় না হলেও হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক এক অভিনেতা। সত্যজিতের ছবি যারা দেখেছেন, তাদের জীবনে সৌমিত্র থাকবেনই একটা ছাপ রেখে। আর তিনি নিজেই বলেছেন, বোম্বের আলো হাওয়ায় তার দমবন্ধ হয়ে আসে। কলকাতায় থাকলে, লিখেন বলেন আড্ডা মারেন—মনে হয় এটাই তো জীবন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন কিন্তু সহজ ছিল না। এখন দেখলে মনে হবে ৮৫ বছরের এক সার্থক জীবন। জীবনের শুরু থেকেই ছিল তার চ্যালেঞ্জ। উত্তম কুমারের মত মহাতারকার সঙ্গে তার ক্রমাগত তুলনা, নিজের অবস্থান তৈরি, বিপুল চাহিদা মাফিক রোজগার করে চলা, মঞ্চে কাজ করা, এসব তিনি করে গেছেন জীবনের শেষ অবধি। তার মেয়ের ক্যানসার, তার ক্যান্সার, নাতি এক মারাত্মক এক্সিডেন্টে এখনও চিকিৎসাধীন। এসবকে তো সামলাতে হয়েছেই। রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে নিজেকে সাহস দিতেন সৌমিত্র।
কথায় কথায় আমরা বলি সৌমিত্র, অভিনেতাদেরও অভিনেতা। তার মতো বাচিক উৎকর্ষ অভিনেতা কমই পাওয়া যায়। নিজেকে ভাঙার চেষ্টা প্রতিবার। তিনি ভালো চরিত্র পেলে মোটামুটি ঘরে বসে প্রস্তুতি নিতেন। স্ক্রিপ্ট দাগাতেন। কোথায় শ্বাস নেবেন, কোথায় চায়ে চুমুক দেবেন, বাক্যটায় থামবেন কোথায়, তাও লিখে রাখতেন। ওনার শেষের দিকে ‘ময়ূরাক্ষী’তে দেখুন, অন্যরকম এক মানুষ। মনে হবেই না ইনি কিংবদন্তী সৌমিত্র। তিনি মাঝেমধ্যে বাণিজ্যিক ছবিতে অমনোযোগী অভিনয় করতেন। একবার সত্যজিতের কাছে খেলেন ধরা। সত্যজিৎ খুবই কড়া ভাষায় বোঝালেন, সিনেমা ও পরিচালক যতই সাধারণ হোক তার কাজ অভিনয়টা করে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা, এইখানে হেঁয়ালির অবকাশ নেই। প্রথম জীবনে ছবি বিশ্বাসও তাকে এভাবেই বলেছিলেন, আত্মবিশ্বাসী হয়ে কাজ করতে। আর ভুল-শুদ্ধর কিছু নেই। আমার কাছে যেটা ভুল, তোমার কাছে সেটা ঠিক। অভিনয় পরিবর্তনশীল এক মাধ্যম।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটা ব্যাপার ছিল, তার সিরিয়াসনেস। খুবই সময়ানুবর্তী এক মানুষ। গাড়ি খারাপ হওয়ার জন্য আসতে দেরি হলেও তিনি ছিলেন লজ্জিত। হাঁটুর বয়সী ডিরেক্টরদেরও স্যার বলতেন। তিনি যেদিন কাজ করবেন তা পরিচালকদের জন্য আনন্দের দিন। কারণ তৈরি হয়ে অপশন দিচ্ছেন, এভাবে নাকি ওভাবে? কেউ ভালো অভিনয় করলে বলতেন, দারুণ হচ্ছে। ঋতুপর্ণা কিংবা শতাব্দীদের নিজের মেয়ের মতোই আদর করতেন। শতাব্দী গিয়েছিল বিয়ের কার্ড নিয়ে। তিনি বললেন, বাবার নাম কেটে আমার নাম দিলেও তো হয়, এত ছবি করেছি। সৌমিত্র ভালো অভিনেতা ও ভালো মানুষের এক রেয়ার কম্বিনেশন। ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ ছবিতে যে মানুষকে দেখা যায়, তিনি আসলে সেটাই। করোনার মধ্যে তিনি খুব হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। কাজে ফেরার চেয়ে বড় ব্যাপার ছিল আড্ডায় ফেরা। মানুষ তাকে ভালোবাসতেন, তিনি মিশতে ভালোবাসতেন। আইসোলেটেড জীবন কখনোই তার নয়। চলেই গেলেন করোনার ভেতরে। হাসপাতালেও বলছিলেন, ‘ভালো লাগছে না, আমাকে কোনো বন্ধুর বাড়িতে রেখে আসো।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিন আজ। তিনি আজীবন থেকে যাবেন ভক্তদের অন্তরে।