ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক সিনেমা `শোলে`। রমেশ সিপ্পির পরিচালনায় ১৯৭৫-এর এই অ্যাকশন অ্যাডভেঞ্চার ছবির নেশায় আজও বুঁদ আসমুদ্রহিমাচল ভারত। হলিউড ছবির ছোঁয়া, জাপানি সামুরাই ছবির ধাঁচের সঙ্গে নিটোল দেশি বাণিজ্যিক গল্পের আঁচ এই ছবিকে ভারতীয় দর্শকমনে এত প্রিয় করে তুলেছে।
‘শোলে’ সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি টিকিট বিক্রি হওয়া সিনেমা। চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ এবং বক্স অফিস বিশ্লেষকদের মতে, ‘শোলে’ ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ভারতজুড়ে ১৮ কোটি টিকিট বিক্রি করেছে। সিনেমাটি ৬০টিরও বেশি থিয়েটারে সুবর্ণ এবং রজত জয়ন্তী উদযাপন করেছে।
সিনেমাটিকে প্রায়ই সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, মুক্তির সময় এটি মুম্বাইয়ের মিনারভা সিনেমা হল ছাড়া সব জায়গায় ফ্লপ করে। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটির বাজেট ছিল ৩ কোটি টাকা, যা তখনকার সময়ের অন্যতম ব্যয়বহুল ভারতীয় প্রযোজনাগুলোর মধ্যে একটি।
মুম্বাইয়ের মিনার্ভা থিয়েটারে শোলে ৫ বছর ধরে প্রদর্শিত হয়, যা তখনকার জন্য একটি রেকর্ড। বিদেশে ‘শোলে’ সিনেমা আনুমানিক ২ কোটি টিকিট বিক্রি করেছে। পরে এটি সোভিয়েত রাশিয়ায় মুক্তি পায়, যেখানে সিনেমাটির ৪.৮ কোটি টিকিট বিক্রি হয়। সবমিলিয়ে ‘শোলে’ প্রায় ২৫ কোটি দর্শক দেখেছিলেন, যা একটি অনন্য রেকর্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘শোলে’ সিনেমাকে যখন ফ্লপ ঘোষণা করা হয়েছিল
‘শোলে’ ছবিটি শেষের দিকে ভারতের সবচেয়ে সফল ও সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্র হিসেবে পরিচিত হয়। ছবিটি মোট ৩০ কোটি রুপি আয় করে, যা "মুগল-এ-আজম" এবং "মাদার ইন্ডিয়া"র রেকর্ডকে অনেক পিছনে ফেলে দেয়। তবে ছবিটি প্রথমে জনপ্রিয়তা পায়নি।
ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগে মুক্তি পাওয়ার পর ছবিটি খারাপ রিভিউ এবং নেতিবাচক কথা-বার্তার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসলে, প্রথম দুই সপ্তাহে শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা এটি ফ্লপ বলে অভিহিত করেন এবং নির্মাতারা তখন সিনেমার বিখ্যাত ক্লাইম্যাক্স পরিবর্তনের কথা ভাবছিলেন। তবে পরবর্তীতে ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে এবং বাকিটা ইতিহাস। ‘শোলে’ সিনেমার প্রাথমিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন পরিচালক রমেশ সিপ্পি। তিনি শেষ মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, যা সিনেমাটিকে একটি বিশাল সাফল্যে পরিণত করে। সিনেমায় আহমেদ চরিত্রে অভিনয় করা শচিন পিলগাঁওকর বলেছিলেন, সিনেমা মুক্তির সময়ে উত্তেজনা ছিল এবং মিনারভা থিয়েটারেই প্রথম সিনেমাটির সাফল্য ঘোষণা করে।
শোলের কিছু কৌতুক দৃশ্যের জন্য সমালোচনা করা হয়েছিল, যেগুলো কিছু দর্শক মনে করেছিলেন, সিনেমার অ্যাকশন ভিত্তিক গল্পের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, সিপ্পি সিনেমা থেকে প্রথমে জগদীপ এবং আসরানির চরিত্রের কৌতুক দৃশ্যগুলো মুছে ফেলেন। তবে সিপ্পি লক্ষ্য করেন, একমাত্র মিনারভায় মূল এডিটটি ভালো চলছে। তিনি দ্রুত এই দৃশ্যগুলোকে সব প্রিন্টে পুনরায় যোগ করেন এবং এরপর সিনেমাটি অন্যান্য থিয়েটারগুলোতে সফল হতে শুরু করে।
শোলে নিয়ে অমিতাভ বচ্চন বলেছিলেন, সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য কিছু দৃশ্য পুনরায় শুট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে, তারা বচ্চনের চরিত্র পুনরুদ্ধার এবং জয়ার চরিত্রের জন্য একটি সুখী সমাপ্তির নতুন পরিকল্পনা করেছিলেন। যখন তারা শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন রমেশ সিপ্পি সিদ্ধান্ত নেন, সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত যাতে দেখা যায় সিনেমাটি কি সাফল্য পায়। অবশেষে, সিনেমাটি ইতিহাস সৃষ্টি করে।
অন্যান্য ভারতীয় সিনেমা থেকে অনন্য অবস্থানে দাঁড়িয়ে ‘শোলে’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু ভারতীয় সিনেমা বিশ্বব্যাপী ১ হাজার কোটি টাকার উপরে আয় করেছে। এই সিনেমাগুলো লাখ লাখ দর্শকের মন জয় করলেও, "শোলে" সিনেমার সঙ্গে তাদের তুলনা করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, বাহুবলী ২-র বিশ্বব্যাপী দর্শক সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ কোটি, যেখানে আরআরআর এবং কেজিএফ অধ্যায় ২-এর দর্শক সংখ্যা ১০ কোটি-এর নিচে। সবথেকে বেশি আয় করা ভারতীয় সিনেমা `দাঙ্গাল`-এর দর্শক সংখ্যা এসব সিনেমা থেকে কিছুটা বেশি, ১০ কোটি।