• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩০, ১৫ শা'বান ১৪৪৬
বার্লিনে বায়োস্কোপ ৩

মধ্যরাতে ষোড়শী আখ্যান


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫, ০৪:২৮ পিএম
মধ্যরাতে ষোড়শী আখ্যান
বার্লিন থেকে বিধান রিবেরুর জার্নাল

মনে মনে ভাবছি উৎসব শুরু হতে আর একদিন বাকি। তার আগেই রাত নয়টায় আমার ছবি দেখা শুরু হবে। অফিশিয়ালি উৎসব শুরু হচ্ছে ১৩ ফেব্রুয়ারি, কিন্তু এর আগে প্রচুর প্রেস স্ক্রিনিং হয়। আমি কাজ এগিয়ে রাখতে প্রেস স্ক্রিনিংয়ে যাচ্ছি। ফিপ্রেসি জুরিদের সকলেই তাই করছে। আমার প্রথম ছবিটি পার্সপেক্টিভস সেকশনের, আর আমার দায়িত্ব এই বিভাগ থেকেই একটি ছবিকে পুরস্কার দেয়া। অবশ্য আরো দুজন থাকবেন আমার সাথে জুরি বোর্ডে। তাদের পরিচয় যথাস্থানে দেয়া হবে। তার আগে ১২ ফেব্রুয়ারি, বুধবারের কাহিনি বলি।


এদিন সারাদিন বসে বসে লিখেছি, পড়েছি আর ঢাকায় যোগাযোগ করেছি। খাওয়াদাওয়াও করিনি। সকালে শুধু আগের দিন কিনে আনা চিজ দেয়া খোয়াজো আর সসেজ খেয়েছি। এদিন সকালে আগেরদিন খাওয়া নাস্তাটি মিস করছিলাম। কিন্তু ঠাণ্ডার ভেতর বাইরে যেতে ইচ্ছে করছিল না, তাছাড়া লেখা ছেড়ে উঠতেও পারছিলাম না। দ্বিতীয়দিনের নাস্তায় ছিল গোফ্লুগোলবুলেট (geflügelbulette), মানে মুরগির মাংস দিয়ে বানানো বড়া আর সাথে আলুর সালাদ, নাম কারতোফেলজালাত (kartoffelsalat)। জার্মানরা নাকি আলু দিয়ে নানাবিধ পদ বানাতে ওস্তাদ। তো সেই ওস্তাদি বোঝা যাচ্ছে ভালোই। 

 

তৃতীয়দিনও ভেবেছিলাম ক্যাফে মঁ শেরিতে গিয়ে আবার এই নাস্তা করবো, কিন্তু সেটা আর হয়নি। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবদি বিস্কুট খেয়ে বের হলাম খাবারের সন্ধানে। খেয়েই দৌঁড়াতে হবে স্ক্রিনিংয়ে। তো বাসা থেকে বেরিয়ে একটু সামনে গিয়ে দেখি ডোনার কেবাব নামে একখানা তুর্কি রেস্তোরাঁ দাঁড়িয়ে আছে। মন খুশি হয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে কাবাব, রুটি আর সালাদ খেলাম। বাসার জন্য কিছু খাবার কিনে রেখে বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রথম স্ক্রিনিং দেখার জন্য। ছবির নাম ‘লিটিল ট্রাবল গার্লস’ (২০২৫), পরিচালক উড়স্কা জুকিচ (Urška Djukić)। স্লোভেনিয়ান চলচ্চিত্র। তবে প্রযোজনায় ইতালি, ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়াও রয়েছে।

 

যথারীতি জুলিয়াস-লেবার-ব্রুকের দুই নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ওরানিয়েনবার্গগামী এস-ওয়ান মেট্রোরেলে চড়ে বসলাম। মাঝে ইয়র্কস্টর ও আনহাল্টার-বানহোফ এই দুটি স্টেশন। পটসডেমার প্লাৎজে নেমে ধীর পায়ে এগুলাম সিনেম্যাক্সের দিকে। সাড়ে সাতটার শো দেখার জন্য ভিড় করছে লোকজন। এরমাঝে আমি এক কোনায় গিয়ে বসলাম। দূর থেকে দেখি হোসাম ফাহমি আসছে। ও মিশরের ফিল্ম ক্রিটিক, কিন্তু বার্লিনেই থাকে। আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল রিয়াদের ফিল্ম ক্রিটিসিজম কনফারেন্সে। আমাকে দেখে খুশি হলো। বলল, ও স্ক্রিনিংয়ে যাচ্ছে, ছবি শেষে একসাথে বসে পান করা যাবে। বললাম, তুমি যাও, আমার সাথে দেখা হবে না। কারণ আমার ছবি শুরু হবে রাত নয়টায়। শেষ হতে দেড় ঘন্টা। কাজেই বাই বাই। পরে দেখা হবে। ও চলে গেল।

 

সময় কাটছে না। একবার পাশের শপিংমলে যাই। আরেকবার বের হই। কিন্তু বেরিয়ে হাঁটার কোনো জো নেই। হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা। আবার ভেতরে ঢুকি। মনির সাথে ফোনে কথা বলি। যদিও তখন ঢাকায় রীতিমতো মধ্যরাত। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। সুখদুখের আলাপ করে কিছু সময় কাটাই। পরেরদিন মনের সায়েন্স প্রজেক্ট ডিসপ্লে। ওর মাকেই নিয়ে যেতে হবে। কাজেই ফোন ছাড়তে হলো। হাতে শিডিউলটা নিয়ে বসলাম। মেলাতে শুরু করলাম বৈঠক ও ছবি দেখার ফাঁকে কখন সময় বের করা যায়। কারণ আমার জার্মান বন্ধু, চলচ্চিত্র সমালোচক টিমো পার মিউনিখ থেকে আসবে। ও দেখা করতে চাইছে। বললাম, দেখা হবে নিশ্চয়, এক ফাঁকে সেটা করে নেব।

 

আজ সন্ধ্যাটা হলো ফেস্টিভাল ইভ, ক্রিসমাস ইভের মতো। শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি চলছে। আমার দায়িত্ব যেহেতু পার্সপেক্টিভস বিভাগের ছবি দেখা তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই এই রাত নয়টার শো দেখছি। নয় তো দিনেই ভালো। কারণ এত রাতে ঠাণ্ডা বেশি, বাংলাদেশের হিসেব করলে ভোর তিনটা-চারটা বেজে যায় ছবি শেষ করতে করতে। কাজেই ব্যাপারটা বেশ কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কি করা, ভালোবাসা আর দায়িত্ব যখন একসাথে হয় তখন সকল কিছুই তুচ্ছ হয়ে পড়ে।

 

পার্সপেক্টিভস বিভাগটি কিন্তু এই বছরের নতুন সংযোজন। নতুন বিভাগের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। ফেস্টিভালের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ও ম্যানেজমেন্ট হেড ট্রিসিয়া টাটলের মাথা থেকে এসেছি এটি। তিনি মার্কিন নাগরিক। চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে তার রয়েছে দুই যুগেও বেশি অভিজ্ঞতা। একসময় ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। ২০২৪ সালের এপ্রিলে তিনি বার্লিনালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উনার পরামর্শেই পার্সপেক্টিভস সেকশনটা শুরু হয়। এর আগে, ২০০৬ সাল থেকে বার্লিনালে বেস্ট ফার্স্ট ফিচার অ্যাওয়ার্ড দিয়ে আসছিল, কিন্তু সেরা ডেব্যু ফিল্মটি জুরিদের বাছাই করতে হতো অন্য প্রতিযোগিতা বিভাগে ছড়িয়ে থাকা ছবিগুলো থেকে। এটা মুশকিলের কাজ। কাজেই ওরা করল কি, প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলোকে একটি জায়গায় নিয়ে এল, নাম দিল পার্সপেক্টিভস। ট্রিসিয়া বলেন, সারা দুনিয়ার ব্যতিক্রমী উঠতি নির্মাতাদের একটি দৃশ্যমান মঞ্চ হয়ে উঠবে পার্সপেক্টিভস। দুনিয়াকে দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আছে সেরকম চলচ্চিত্রের ভাষাকেই এই বিভাগে স্থান দেয়া হবে।

ট্রিসিয়ার কথা অক্ষরে অক্ষরে অনুধাবন করলাম, যখন রাত নয়টায় উড়স্কা জুকিচের ডেব্যু ছবিটি শুরু হলো। ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারও হচ্ছে এবারের বার্লিনালে। বিশাল স্ক্রিনের মাঝে একটি শিল্পকর্ম দিয়ে শুরু হয় ছবিটি। যোনি। নারী যখন ঋতুমতী হয়, তখন গোটা দুনিয়া তার সামনে কিভাবে ধরা দেয় এই ছবি তারই বয়ান হাজির করে অভিনব কায়দায় দৃশ্যাবলী সজ্জার মাধ্যমে। শুধু দৃশ্য নয়, শব্দের ব্যবহারেও রয়েছে সৃজনশীলতা। ষোলো বছর বয়সী লুসিয়া যখন রজঃস্বলা হয়ে উঠছে, তখন সে মায়ের শাসন, বান্ধবীর সাথে সমকামী ভালোবাসা, পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণকে নতুন করে আবিষ্কার করে। বা বলা যেতে পারে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে এই বিপুলা পৃথিবীর জটিল অরণ্যে। যেখানে ধর্মের অনুশাসন রয়েছে, পাপবোধের চাপ রয়েছে, আবার দুর্বার যৌনাকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। 

 

মিশনারী স্কুলে পড়ুয়া লুসিয়া একদিকে ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে একাত্ম হতে চায়, সে চুম্বন করে মাতামেরীর ঠোঁটে; অপরদিকে সে ধর্মের বিধিনিষেধকে ভেঙেও ফেলতে চায়, মাতামেরীর ডানহাত ভেঙে ফেলার দৃশ্যকল্প ভাসে তার চোখে। এই ছবি বয়োসন্ধিকালে শরীর ও দুনিয়া যে সান্ধ্যভাষা নিয়ে হাজির হয় কিশোরীর সামনে, তারই শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। শব্দকে গুরুত্ব দিয়ে, এক্সট্রিম ক্লোজাপের ব্যবহার করে, ছবিতে নারীর যৌনতাকে করে তোলা হয়েছে অনেক বেশি প্রতীকায়িত। মাতামেরির মূর্তিটি মোটিফ আকারে এসেছে। ঝর্ণা এসেছে যৌবনে প্রবেশিকার চিহ্নায়নের পথ ধরে।

 

তো ষোড়শীর এই আখ্যান দেখা যখন শেষ হলো তখন ঢাকায় রাত সাড়ে তিনটা। আমার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে ঘুমটুম সব হাওয়া। বিস্ময় ও চিন্তায়। দেখি নরম তুলতুলে তুলার মতো তুষার ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। পথঘাট ছেয়ে যাচ্ছে সফেদ বরফে। আমি ছবি তুললাম। এমন অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। তুষারপাতের ভেতর হেঁটে হেঁটে মেট্রোস্টশনের দিকে যাচ্ছি। পেঁজাতুলোর মতো বরফ আমার গায়ে এসে আলতো করে বসছে, তারপর গলে জল হয়ে যাচ্ছে। এমনকি চোখের পাপড়িতেও তারা মোলায়েম পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই রোমান্টিকতা দিয়ে তো বাসায় ফেরা যাবে না। আমি দ্রুত পা চালিয়ে পাতাল স্টেশনে ঢুকে পড়ি। উল্টোপথে যখন গন্তব্যে পৌঁছুলাম, উঠে দেখি রাস্তায় এক ইঞ্চি পুরু বরফ জমে গেছে।

 

নতুন অভিজ্ঞতার কারণে আনন্দ লাগছিল, কিন্তু শঙ্কিত হচ্ছিলাম পিচ্ছিল পথের কারণে। আমার আবার আছাড় খেয়ে পড়ার রেকর্ড আছে। অতয়েব খুব সাবধানে পা ফেলে বাসার দিকে হাঁটছি। রাত পৌনে এগারোটা বাজে। রাস্তাঘাট শুনশান প্রায়। নিয়ন আলো জ্বলছে। মাঝেসাঝে দুই একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে হুশ করে বরফ কেটে চলে যাচ্ছে। এর ভেতর দেখলাম অদূরের সিগনালে, একজোড়া নরনারী পরস্পরকে বিদায় জানাচ্ছে আলিঙ্গনের মাধ্যমে। অতঃপর চুম্বন। অপর্যাপ্ত হলদে আলোর ভেতর ঝরে পড়া তুষারের নিচে এ যেন বাস্তব নয়, রোমান্টিক চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্য। এরপর কিছু হাসির মুদ্রা টুংটাং শব্দ করে আছড়ে পড়ল শ্বেত মেঝেতে। রাতের নিঃস্তব্ধতা আড়মোড়া ভেঙে আবার শুয়ে পড়ল। হাত নেড়ে দুজন চলে গেল দুদিকে। আমি পা বাড়ালাম আমার বাসার দিকে। চাবিটা বের করতে হবে। দ্রুত।  

Link copied!