মঞ্চেই শুরু, মঞ্চেই শেষ! ভক্তদের আনন্দ দিয়েই চিরতরে বিদায় নিয়েছেন ভারতের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নথ। বলিউড পাড়ায় কেকে নামেই বিখ্যাত এই সংগীতশিল্পী। ক্যারিয়ারে অসংখ্য গান উপহার দিয়েছেন ভক্তদের। শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও ছিলেন ভক্তদের কাছাকাছি। গানের জগতে জনপ্রিয়তা দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন ভক্তদের ভালোবাসা।
৩১ মে মঞ্চ মাতাতে মাতাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এই সংগীতশিল্পী। এরপর কিছু বুঝে উঠার আগেই চিরতরে বিদায় নেন। হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকে তার নিস্তব্ধ দেহ। সুরের ঝঙ্কারে কিছুক্ষণ আগে মঞ্চ মাতানো এই গায়ক মুহূর্তেই নিস্তর হয়ে যাবে, এ যেন কল্পনাতীত!
কেমন ছিল কেকের শেষ মুহূর্তগুলো? মঞ্চে তার সরব উপস্থিতি বলে দেয়, তিনি একদমই ফিট ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেকের মঞ্চ মাতানোর শেষ মুহূর্তগুলো প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে দেখা গেছে, প্রাণচঞ্চল কৃষ্ণকুমার কুন্নথকে। তার সঙ্গে থাকা মানুষগুলোও শেষ স্মৃতি স্মরণ করে ভারাক্রান্ত হচ্ছেন। প্রকাশ করছেন নিজেদের কষ্ট আর সহানুভূতি।
কেকের শেষ মুহূর্তটি কেটেছে ভিড়ে ঠাসা নজরুল মঞ্চে। যেখানে ছিল আলোর ঝলকানি। মঞ্চে গাইছেন বলিউডের গায়ক কেকে। গানের মাঝে বার বার ঘামছিলেন। রুমাল দিয়ে মুখ-কপালের ঘাম মুছছেন। বারবার বোতল থেকে পানি পানি করছেন। তবুও গেয়েই চলেছেন একের পর এক জনপ্রিয় গান। মাতাচ্ছেন মঞ্চ। বাজছে ভক্তদের কড়তালি। আরও জোশ নিয়ে গান করে যাচ্ছিলেন জনপ্রিয় এই সংগীতশিল্পী।
নজরুল মঞ্চের কেকে-র লাইভ অনুষ্ঠানের একাধিক ভিডিওতে ধরা পড়েছে এমন দৃশ্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা অনেকেই বলছিলেন, মঞ্চে দরদর করে ঘামছিলেন শিল্পী। হয়তো মঞ্চেই অসুস্থ বোধ করছিলেন তিনি। কিন্তু তেমন করে গুরুত্ব না দিয়েই গান গেয়ে যাচ্ছিলেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ভক্তরাও বলছেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেকে ছিলেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত। মঞ্চের এপাশ-ওপাশ দাপিয়ে গান গেয়েছেন। এর মাঝেই বার বার চলে যাচ্ছিলেন মঞ্চের পিছনে। যেখানে রাখা ছিল রুমাল আর পানির বোতল। এক গানের বিরতিতে ঘাম মুছে নিচ্ছিলেন। এরপর পানি পান করে আবারও মঞ্চে সোচ্চার হয়ে উঠেন নিজের গান দিয়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওতে দেখা যায়, কেকে টেবিল থেকে রুমাল তুলে মুখ মুছছেন। মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে আবারও গান শুরু করছেন।
পাশ থেকে মঞ্চে থাকা একজন বলে উঠলেন, ‘‘ভীষণ গরম।’’ শিল্পী সেই দিকে তাকিয়ে হেসেও ছিলেন। এরপর কেকে হাতের ইশারা দিয়ে মঞ্চের উপরের আলোগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘নিভিয়ে দাও।’ এরপর ভক্তদের মাতাতে শুরু করেন আরো একটি গান।
ওই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেছিলেন শুভলক্ষ্মী দে। কেকের সঙ্গে কাটানো শেষ মুহূর্তটির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “অনুষ্ঠানে এসে গাড়িতেই বসে ছিলেন কেকে। ভিড়ের কারণে ঢুকতেই পারছিলেন না। এরপর গ্রিনরুমে বসানো হয়। আমি গিয়ে দেখা করি। গ্রিন রুমে গিয়ে অন্য শিল্পীর সঙ্গে দেখা করেন। সবার সঙ্গে ভালোভাবে কথাও বলেছেন। তাকে কোনও ভাবেই অসুস্থ মনে হয়নি। অনুষ্ঠানের সময় ভীষণই এনার্জেটিক লাগছিল। ভাবতেই পারিনি এমনটা হবে!”
ভক্তদের একজন গুরু নানক ইনস্টিটিউটের ছাত্র রোহিত সাউে বলেন, ‘‘প্রচুর ভিড় হয়ছিল। বাইরেও অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটা সময় দরজা খুলে দেওয়া হয়। এতো গরম লাগছিল, মনে হচ্ছিল, এসি কাজ করছে না। আসনসংখ্যার চেয়ে বেশি মানুষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল।’’
শেষ গান গেয়ে কেকে মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখনও দেখা গেছে, কপাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। শরীরও ঘামে ভেজা। সেখান থেকে কলকাতার হোটেলে ফিরে যান। কিন্তু হোটেলে ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। তার সঙ্গীরা তাকে একবালপুরের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ততক্ষণে নিস্তব্দ কেকে। চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। উপস্থিত সবাই যেন থমকে যায়।
কেকের সফরসঙ্গী কলকাতার তোচন ঘোষ বলেন, “অনুষ্ঠান শেষে গাড়িতে ফিরতে ফিরতেই বলছিলেন, শরীরে কেমন অস্বস্তি করছে। বড্ড ঠান্ডা লাগছে! ওঁকে নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। এক বারের জন্য বুঝতে পারিনি, আমার নজরুল মঞ্চের অনুষ্ঠানই ওঁর শেষ অনুষ্ঠান হবে। এই আফসোস সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকল।“
হাসপাতালের বিছানায় তখন চিরঘুমে কেকে। ৫৪ বছর বয়সী তরতাজা সেই প্রাণ এভাবেই চলে যাবে তা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না ভক্তদের।খ্যাতনামা সুরকার জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কেউ যেন বিশ্বাসই করছেন না, ‘কেকে নেই!’
শেষ মুহূর্তের ঘটনাটি জানিয়ে কেকের সঙ্গীরা বলেন, “হোটেলের লবিতে পা রাখা মাত্র তাকে ঘিরে ধরে অসংখ্য ভক্ত। সেও সবসময় ভক্তদের সঙ্গে ছবি তোলে। কিন্তু মঙ্গলবারের রাতে এই প্রথম কেকে ভক্তদের আবদার রাখতে পারেননি। সবাইকে জানায়, সে অসুস্থ। নিজের ঘরে যেতে চায়। ঘরে গিয়েই শুয়েও পড়ে। তাতেও স্বস্তি পাচ্ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বেসরকারি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সবই শেষ। সেখানে চিকিৎসকেরা জানান, রাস্তাতেই স্তব্ধ হয়ে গেছে শিল্পীর দেহ!”