সমাজের শ্রেণি বৈষম্য নামক শব্দটি যেন হারিয়ে গেছে এখানে এসে। ভাসমান, ছিন্নমূল ও পথ শিশুদের সাথে মিলে মিশে একাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও নানান পেশার মানুষেরা। সন্ধ্যার আজানের কিছুটা পূর্ব মুহূর্তে সবাই মিলে বসে পড়ছে রেল লাইনের প্ল্যাটফর্মের ধারে। সবার চোখে মুখে এক তৃপ্তির ছোঁয়া।
চার অক্ষরের চৌমুহনী। কোটি মানুষের খাদ্য আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বৃহত্তর বাণিজ্যিক নগরী। নোয়াখালীর ৯টি উপজেলার পাশাপাশি কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরের বিভিন্ন উপজেলার পাইকাররা আসেন নিয়মিত। কোটি মানুষের জীবিকা যে বাজারে কেনা-বেচা হয় সেই বাজারে প্রায় অনাহারে থাকে আরেক দল মানুষ।
সুবিশাল রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে খোলা আকাশের নিচে বসবাস দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে আসা ভাসমান, ছিন্নমূল ও পথ শিশুদের। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন কাজ করে একবেলা খাবার আসে তো আরেক বেলা উপোষ থাকতে হয়। দিন এনে দিন খাওয়া এসব মানুষের জন্য ২০২০ সাল থেকে রমজান জুড়ে মানসম্মত ইফতার আয়োজন হয় প্রতিদিন। ‘মানবিক ইফতার’ নামে প্রজেক্টটি পরিচালনা করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আমরা গোলাপ’।
‘বিত্তবানরা এগিয়ে আসায় অর্থায়ন নিয়ে কোন সমস্যা হয় না’ বলে সংবাদ প্রকাশকে জানালেন মানবিক ইফতারের হিসাব রক্ষক সাখাওয়াত রাসেল। তিনি আরও বলেন, “ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, গৃহিণী থেকে শুরু করে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা এখানকার নিয়মিত দাতা। মুসলিমদের পাশাপাশি ইফতারে অনুদানের হাত বাড়িয়ে দেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও। শুধু অর্থায়ন নয়, পরম যত্নে ইফতার তুলে দেন রোজাদারদের হাতে।”
মাসব্যাপী ইফতারের ২৬তম দিনের আয়োজক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লিটন ভৌমিক সংবাদ প্রকাশকে জানালেন, “ভাসমান-ছিন্নমূলদের বড় পরিচয় এরা মানুষ। লালন বলেছেন, ‘মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিনি, দেখেছি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এই ছিন্নমূল মানুষরাই আমার প্রতিবেশী এবং আমাদের রাষ্ট্রের নাগরিক। আমাদের ক্ষুদ্র অংশগ্রহণ যদি তাদের ইফতার নিশ্চিত করে বিষয়টি একইসাথে আনন্দের এবং দায়িত্বেরও। এভাবে মানুষ মানুষের জন্য এগিয়ে আসলে পারস্পরিক সুসম্পর্ক, সামাজিক শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে।”
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ এন্ড মেরিন সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মামুন এমন আয়োজনকে সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আখ্যায়িত করে সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “মানবিক ইফতার আয়োজন সমাজের বিত্তবান ও ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করছে। রমজানের যে মহান শিক্ষা ক্ষুধার্ত ও অভাবীদের দুঃখ কষ্ট অনুভব করা এবং তাদের সাহায্যে যথাসাধ্য এগিয়ে আসা, এই অসাধারণ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তা প্রতিফলিত হয়েছে। আবার জাত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সম্প্রীতির দারুণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এভাবে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে এবং উৎসবগুলো শুভকাজের উপলক্ষ্য হবে।”
আয়োজনের সমন্বয়ক মুনীম ফয়সাল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এখানেই ‘মানবিক ইফতারের’ সাফল্য। ক্ষুধার যেমন ধর্ম হয় না, তেমনি খাবারেরও কোন ধর্ম নেই। আমরা পরিচয় নির্ধারণ করতেও চাই না। এবারের ইফতারের প্রথম ডোনেশন করেন একজন খ্রিষ্টান ভাই। আবার প্রতিবছর ইফতারের বড় একটা ডোনেশন আসে হিন্দু ভাইদের থেকে। আমরা আনন্দিত, মিলেমিশে থাকতে পেরে।”