দেশের দ্বিতীয় প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) সমাবর্তন আয়োজনে বেশ পিছিয়ে। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯ বছরের ইতিহাসে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র ১১টি। অন্যদিকে, ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ৫৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর একজন শিক্ষার্থীর কাছে সমাবর্তন মানে দারুণ উপভোগ্য এক অনুভূতি। কালো রঙের গাউন-টুপি পরে শিক্ষা সনদ গ্রহণ করা গ্রাজুয়েটদের জন্য বিশেষ একটি মুহূর্ত। সেই সুযোগ থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছেন রাবির গ্রাজুয়েটরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত দুই দশকে মাত্র চারটি সমাবর্তন আয়োজন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দশম ও একাদশ সমাবর্তন আয়োজন করে রাবি কর্তৃপক্ষ; সেই সমাবর্তনগুলোতে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান আশ্বাস দেন নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজনের।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অনিয়মিত সমাবর্তন
রাবির প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। স্বাধীনতার পূর্বে (১৯৫৩-১৯৭১) প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরে রাবিতে ৬টি সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে, ১৯২৩ সালে প্রথম সমাবর্তনের পর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত পরিসরেই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাকিস্তান আমলেও ২৪ বছরে ১৫টি সমাবর্তন হয় ঢাবিতে। সেই হিসেবে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজনের সংস্কৃতি তৈরি হয়নি উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বাধীনতার পরও একই ধারা অব্যাহত থাকে। পাঁচ দশকে মাত্র ৫টি সমাবর্তনের আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সমাবর্তন নিয়ে শিক্ষার্থীদের হতাশা
নিয়মিত সমাবর্তন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, সমাবর্তন না আয়োজনের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী জাওয়াদ মাহিন বলেন, “ঢাবিতে ৫৩তম সমাবর্তন হয়ে গেল; কিন্তু ৭০ বছরে রাবিতে কেবল ১১টি সমাবর্তন কোনোভাবেই মানা যায় না। ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সমাবর্তন পেলে অবশ্যই দারুণ একটি অনুভূতি হতো।”
আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী সাজ্জাদ রাকিব বলেন, “নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজন এখন জরুরি। দেশের অন্যতম প্রাচীন একটি বিদ্যাপীঠের সমাবর্তন আয়োজনে এমন অনীহা আমাদের হতাশ করেছে।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন রাবি শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৃহৎ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ গ্রুপে শিক্ষার্থীরা এই দাবি জানাচ্ছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে।
নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজনে বাঁধা কোথায়?
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সময় পাওয়াটা কঠিন। সেই সঙ্গে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য লোকবলের সংকট রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। তবে শিক্ষার্থীদের চাহিদার দিকটি মাথায় রেখে নিয়মিত পরিসরে সমাবর্তন আয়োজনের চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সমাবর্তন আয়োজনে কেন পিছিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়—এমন প্রশ্নের উত্তরে রাবি উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, “আমরা নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজনের পক্ষে। আপনারা দেখেছেন দশম ও একাদশ সমাবর্তন সময় মতোই হয়েছে। করোনার কারণে সেই ধারাবাহিকতা আর বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।”
দ্বাদশ সমাবর্তনের আয়োজন নিয়ে রাবি উপউপাচার্য বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। আচার্যের সম্মতির পাশাপাশি, তিনি কবে সময় দিচ্ছেন সেটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আমরা প্রাথমিক কিছু কাজ সম্পন্ন করেছি। আচার্যের সম্মতি পেলে, দ্বাদশ সমাবর্তনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।”
এদিকে, সমাবর্তনের গঠনগত কিছু পরিবর্তন চেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজেজের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন।
ইংরেজি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “সমাবর্তন অবশ্যই নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমি বলব, অনুষদভিত্তিক সমাবর্তন আয়োজনের দিকে নজর দিতে হবে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। সেই বছইর প্রথম সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়। ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সমাবর্তন। পরবর্তীতে স্বাধীনতার আগে ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৫ এবং ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ সমাবর্তন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বিশেষ একটি সমাবর্তনের আয়োজন করা হলেও, এরপর প্রায় ২৮ বছর কোনো সমাবর্তন আয়োজন হয়নি রাবিতে।
১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম সমাবর্তনের পর আবারও দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিভিন্ন সময় নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজনের আশ্বাস দিলেও, বাস্তবায়নে তেমন উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।