২০২৫ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও সমমান পরীক্ষা (এসএসসি) হবে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী। এই পাবলিক পরীক্ষায় মোট ১০টি বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। এতে থাকবে লিখিত পরীক্ষাও। প্রতিটি বিষয়ের মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের বিরতিসহ ৫ ঘণ্টা পরীক্ষার কেন্দ্রে থাকতে হবে। বর্তমান সময়ের মতো আলাদা পরীক্ষাকেন্দ্রে মূল্যায়নে অংশ নেবে শিক্ষার্থীরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তৈরি করা ‘২০২৫ এর দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক মূল্যায়ন/ পরীক্ষা’ সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মঙ্গলবার এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, পাবলিক পরীক্ষা কীভাবে হবে, এর জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হবে।
জানা যায়, আগামী বছর দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা মোট ১০টি বিষয় পড়বে। বিষয়গুলো হলো—বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, ধর্মশিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি। এই পাঠ্যসূচির ওপর অনুষ্ঠিত হবে পাবলিক পরীক্ষা।
পরীক্ষায় কীভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে, তা নিয়ে প্রতিবেদনে একটি রূপরেখা দেওয়া আছে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিষয়ের চাহিদা ও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রকল্পভিত্তিক কাজ, সমস্যা সমাধান, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদির পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। মূল্যায়নে অনুসন্ধান, প্রদর্শন, মডেল তৈরি, উপস্থাপন, পরীক্ষণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় থাকবে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, লিখিত মূল্যায়নে ৫০ শতাংশ ওয়েটেজ থাকবে। আর বাকি ৫০ শতাংশ ওয়েটেজ থাকবে কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নে। পরীক্ষার মান ও মূল্যায়নে নিরপেক্ষতা যাতে বজায় রাখা যায়, সে জন্য লিখিত মূল্যায়নে বর্তমান পাবলিক পরীক্ষার মতো খাতা ব্যবহার করা হবে। আর পরীক্ষা শেষে একযোগে ফল প্রকাশ করবে শিক্ষা বোর্ডগুলো।
এ বিষয়ে এনসিটিবির এক কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ বলেন, বর্তমান পাবলিক পরীক্ষায় ওএমআর শিটভিত্তিক খাতা ব্যবহার করা হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের খাতা মূল্যায়নেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে, যাতে মূল্যায়নকারী শিক্ষক খাতাটি কোন শিক্ষার্থীর, তা বুঝতে না পারেন। এতে নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে। তিনি আরও বলেন, মূল্যায়নের জন্য সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে বিরতিসহ ৫ ঘণ্টা। এর মধ্যে বিভিন্ন মূল্যায়নের ফাঁকে ফাঁকে ১ ঘণ্টা বিরতি থাকতে পারে।
নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষার নাম এখনকার মতো মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা থাকবে বলে নিশ্চিত করেছেন শিক্ষা বোর্ডগুলোর সমন্বয় কমিটির প্রধান ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নকাঠামো চূড়ান্ত করতে শিক্ষা বোর্ড ও অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে এনসিটিবি। পরিকল্পনা রয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে নবম শ্রেণির বার্ষিক মূল্যায়ন/পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষার আদলে আয়োজন করে এ মূল্যায়নকাঠামোর পাইলটিং করা।
নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণের সার্বিক আয়োজনের জন্য বিষয়ভিত্তিক ৬০০ শিক্ষকের সমন্বয়ে রিসোর্সপুল গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে এনসিটিবির। রিসোর্সপুলকে প্রথমে বোর্ডের আয়োজনে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ৭ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের প্রতিটির জন্য প্রতি বিষয়ে ৪ জন করে মোট ৪৪ জন শিক্ষককে চূড়ান্ত করা হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হয়। আর চলতি বছর বাস্তবায়ন করা হয় দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রম চালু হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে বর্তমানে দুই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হয়। এর একটি বছরজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন মূল্যায়ন, অন্যটি বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়ন। শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী, প্রাক্-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। এ তিন শ্রেণিতে হবে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন। আর চতুর্থ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব বিষয়ে কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, পাবলিক পরীক্ষাকে চাপমুক্ত এবং আনন্দদায়ক করার লক্ষ্য থেকে মূল্যায়নকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এ কাঠামোতে শিক্ষার্থীরা লিখিত ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নে অংশ নেবে। এগুলোর মধ্যে আন্তসম্পর্ক থাকবে।
এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন নিয়ে পাঁচ দফা সুপারিশ প্রস্তুত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত ১৪ সদস্যের কমিটি। গত সোমবার কমিটি এ নিয়ে এনসিটিবির সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠক সূত্র জানায়, মূল্যায়নে লিখিত পরীক্ষা রাখার সুপারিশ করেছে কমিটি। এতে বলা হয়, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যোগ্যতা ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি লিখিত মূল্যায়নও রাখা যেতে পারে। লিখিত মূল্যায়নের ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ এবং কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ করা যেতে পারে। স্কুলভিত্তিক ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক মূল্যায়ন এবং পাবলিক মূল্যায়নও একই পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে।
এ ছাড়া মূল্যায়ন অ্যাপ নৈপুণ্য হালনাগাদ করা, চূড়ান্ত মূল্যায়ন সনদ/ট্রান্সক্রিপ্টের ৭ পর্যায়ের স্কেলে যোগ্যতা ও পারদর্শিতার সূচক অভিভাবক ও অংশীজনদের অবহিত করার সুপারিশ করেছে কমিটি।
গত ৫ মার্চ গঠিত এ কমিটির আহ্বায়ক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মোহাম্মদ খালেদ রহীম। জানতে চাইলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, মূল্যায়ন নিয়ে কিছু সুপারিশ রয়েছে। শিগগির প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিক জমা দেওয়া হবে।