সামিয়া নাজ স্বীকৃতি, পড়াশোনা করছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি এখন একজন উদ্যোক্তা। নিজ হাতের তৈরি পণ্য বিক্রি করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এখন বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। তার এই পর্যায়ে আসার পিছনের গল্পগুলো শুনিয়েছিলেন সুদীপ চাকমাকে।
স্বীকৃতি বলেন, “আমার জন্ম বেড়ে ওঠা কুমিল্লার শহরে। ছোটবেলা থেকেই আমার ভীষণ ঝোঁক ছিল কাটাকুটি ও ছবি আঁকার প্রতি। ছুটি পেলে বসে পড়তাম রং আর তুলি নিয়ে। এখনও সময় পেলেই আমি আঁকাআঁকি করে সময় পার করি। বাড়িতে যখনই কোনো পুরাতন জিনিস পাই, সেগুলোকে রং দিয়ে রাঙিয়ে তুলতে আমার বেশ ভালো লাগে এবং চেষ্টা করতাম সেগুলো দিয়ে ভিন্ন কিছু করার। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন দেখলাম পরিচিত সবাই টিউশন করে তাদের খরচ নিজেরাই বহন করছে, আমিও চেয়েছিলাম আত্মনির্ভরশীল হতে।”
যেভাবে শুরু
সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘প্রত্নের রত্ন’ নামে পেইজ খোলা নিয়ে আমার তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ব্যবসা শুরু করবো কি করবো না এই নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। তবে আমি হুট করে একদিন বেশি কিছু না ভেবে একটা পেইজ খুলে নিই এবং সেখান থেকেই শুরু আমার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিজের তৈরি পণ্য বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনেও হাতের তৈরি গয়না যেমন- কানের দুল, হাতের রিং,গলার মালা, পায়েল, ব্রেসলাইট, আয়না ছাড়াও হোমমেড আচার বিক্রি করে থাকি।
প্রত্নের রত্ন নামকরণের গল্প
সব পরিকল্পনা ঠিকঠাক হওয়ার পর আমি পেইজের জন্য একটা ইউনিক নাম খুঁজছিলাম। তখন হঠাৎ মনে হলো, আমি যেহেতু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে পড়াশোনা করছি, নামটাও সেই হিসেবে রাখা যাক। তখন আমার প্রিয় ডিপার্টমেন্টের নামানুসারে ‘প্রত্নের রত্ন’ নামে পেইজটি নামকরণ করি।
আচার বানানোর গল্প
আচার বানানোর পেছনে আমার একটি ছোট্ট গল্প আছে। একদিন আমার ডিপার্টমেন্টের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মুতাসিম বিল্লাহ স্যার ক্লাসের এক পর্যায়ে বিভিন্ন উপদেশ বলে আমাদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন। একসময় তিনি বলে উঠলেন, ‘কোনো কাজ ছোট বড় নয়। তোমরা যা কিছু করতে পারো, সেই মেধাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করতে পারো। যেমন মনে করো তুমি খুব ভালো আচার বানাতে পারো, এটা দিয়েই একটা ব্যবসা শুরু করতে পারো।’
এই কথা শোনার পর আমিও মনে মনে ভাবলাম, আমিওতো খুব ভালো আচার বানাতে পারি, এখন একটু চেষ্টা করে দেখি। তারপর আর কি, আমি বিভিন্ন আচার বানানো শুরু করি। এখন বর্তমানে সেখান থেকে আমার বেশ আয়ও হচ্ছে।
নিজের স্বপ্ন নিয়ে স্বীকৃতি বলেন, “আমি এই ব্যবসার পেছনে অনেক সময়, ধৈর্য আর পরিশ্রম ব্যয় করেছি। আল্লাহর রহমতে এখন আমি বেশ সাড়াও পাচ্ছি। অনেক ভালো লাগে যখন দেখি আমার নিজের বানানো গয়না পরে অনেকেই ঘোরাঘুরি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে দিচ্ছে। তখন নিজে নিজেই খুব গর্ববোধ করি। আসলে এসব কাজ করতে অনেক সময় আর ধৈর্য প্রয়োজন হয়। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে এসব জিনিস তৈরি করি। দিন শেষে যখন কেউ আমার জিনিসগুলো পছন্দ করে তখন আমার নিজের কাছেই এই কষ্টগুলো সার্থক মনে হয়। আমি এখনও একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী। আমার ইচ্ছা একদিন আমার এই ছোট্ট পেইজটাকে অনেক বড় করে তুলবো।”
মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান বলেন, “একদিন ক্লাস থেকে আসার সময় তার স্টল থেকে একটা আচার কিনেছিলাম, যা খুবই দারুণ ছিল। তখন তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। আসলে প্রথম বর্ষ থেকে তার এমন উদ্যোগ নেওয়া খুবই সাহসী পদক্ষেপ। সাধারণত আমরা সবাই টিউশনি করে নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করি, কিন্তু সে ঐ পথে না হেটে নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে। আমি চাই তার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী নতুন কিছু করার আগ্রহ প্রকাশ করুক।”
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুতাসিম বিল্লাহ বলেন, “শিক্ষক হিসেবে আমার কর্তব্য শিক্ষার্থীদের একমুখী করে গড়ে না তুলে তাদের বহুমাত্রিক চিন্তায় অনুপ্রাণিত করা। পরামর্শ আমরা প্রতিনিয়ত দিলেও সব পরামর্শ সব সময়ে সমানভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। অনেকে করে আবার অনেকেই করবে সিদ্ধান্ত নিলেও পিছপা হয়ে যায়। কিন্তু স্বীকৃতি প্রথম বর্ষ থেকেই নতুন কিছু করার সাহস দেখিয়েছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।”