অবিলম্বে আইন‑শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও জাতি‑ধর্ম‑মত নির্বিশেষে কারও ওপর সহিংসতা না চালানো এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
শনিবার (১১ আগস্ট) বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কী চাই’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব উপস্থাপনের পাশাপাশি এ দাবি জানানো হয়।
সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব উপস্থাপনের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি‑পেশার মানুষের সাথে এ সম্পর্কিত মতবিনিময় করা হয়। এতে শিক্ষক নেটওয়ার্কের তরফ থেকে লিখিত প্রস্তাব পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীপ্তি দত্ত, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিন্যু কিবরিয়া ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেহরিন খান ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের লাবণী আশরাফি। জানানো হয়, এটি প্রাথমিক প্রস্তাব। এ প্রস্তাবের পাশাপাশি সভায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁদের আরও প্রস্তাব যুক্ত করেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ। তিনি বলেন, ‘বারবার রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ আসবে না। অনেক প্রস্তাব ও কথা আলোচনায় এসেছে। সঠিক কর্মপন্থা তৈরি করতে পারলে কোথাও পৌঁছাতে পারব বলে আশা করছি। জানপ্রাণ দিয়ে প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করব।’
সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি একটাই—ঘাড় ঘুরিয়ে জনগণের দিকে নিয়ে আসতে হবে। সরকারের ঘাড় লুটেরা ব্যবসায়ী, সম্পদ পাচারকারী ও প্রকল্প বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়াদের থেকে ঘোরানো। এই ঘাড় জনগণের দিকে ঘুরিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায় নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই সংবিধানের অধীন যে–ই ক্ষমতায় যাবে, সেই স্বৈরাচার হয়ে যাবে। আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানে বড় বদল আনতে হবে।’
তিনটি গোষ্ঠীর কাছ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ঝুঁকিতে রয়েছে জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, গত ১৫ বছরে যারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে, সিভিল ও মিলিটারি আমলাতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী—এই তিনটি গোষ্ঠীর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও জনগণের ওপর গুলি চালানো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কী কী করতে চায়, সেটি তুলে ধরলেই তাদের মেয়াদ কত দিন হতে পারে সেটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। যার আদেশে জুলাই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচারের জন্য সরকারকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে।
পূর্বপরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, আগের সরকার অনেক অবৈধ অস্ত্র মানুষের হাতে দিয়ে গেছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও যারা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আমলাদের আইনি দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে উল্লেখ করে তানজীমউদ্দিন খান বলেন, অধিকাংশ আইনে যুক্ত করা হয়েছে—কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম হলে দায়মুক্তি পাবেন। তিনি বলেন, মানুষকে হত্যা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার যে চেষ্টা করা হয়েছে, তা স্বাধীন দেশে মেনে নেওয়া যায় না।
লিখিত প্রস্তাবে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছিল। এই রূপরেখা উপস্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরাচারীর পতনের দ্বারপ্রান্তে এসে বহু মানুষের প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হবে, তা যেন আবার একটি নতুন স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে তা নিশ্চিত করা। এই রূপরেখা নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক হয়েছে যা আমাদের ইতিবাচক মনে হয়েছে। রূপরেখাটি খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল কারণ আলোচনাসাপেক্ষে, তর্ক-বিতর্ক ও মত-বিনিময়ের মাধ্যমে এই রূপরেখাটিকে আমরা আরও সম্প্রসারিত করতে চেয়েছি। আজকে আমরা আন্দোলনের বিভিন্ন অংশীজনের সাথে সে আলোচনার সূত্রপাত করতে যাচ্ছি।’
প্রস্তাবে অন্তর্বর্তী সরকারের আশু করণীয় হিসেবে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের আশু করণীয় হিসেবে বলা হয়–
১। জনগণের জান-মালের সুরক্ষায় অবিলম্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামতে হবে ও সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের জন্য সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পস্থাপনা, উপাসনালয়, মাজার, ভাস্কর্য, পাঠাগারের ওপর হামলা ঠেকাতে হবে ও হামলার বিচার করতে হবে।
৩। জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং জনগণের ওপর নৃশংস জোর-জুলুমের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতায় তদন্ত কমিটি এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত তদন্ত ও বিচারকাজ শুরু করতে হবে।
৪। কোটা আন্দোলনে যারা আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে ও আন্দোলনে নিহতদের পরিবারকে সাবলম্বী করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪। সাম্প্রতিক সময়ে করা মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক ও হয়রানিমূলক মামলা বাতিল করতে হবে এবং এসব মামলায় আটক সবাইকে মুক্তি দিতে হবে।
৫। অর্থনীতির চাকা সচল করতে শিল্প-কলকারখানা খুলে দিয়ে সকলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে করণীয় হিসেবে বেশ কিছু খাতের কথা উল্লেখ করা হয় প্রস্তাবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য–পাড়ায় পাড়ায় খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার, মুক্ত উদ্যান, পাঠাগার ইত্যাদি চালু করা; সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে কমিউনিটি সেন্টার চালু করা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধসহ মানুষের মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন অধ্যায়সহ জুলাই হত্যাকাণ্ডে নিহত শহিদদের তালিকা, স্মৃতিস্তম্ভ, এবং ছবি থাকবে, শিল্প-সংস্কৃতির নানা শাখায় কাজ হবে; গণমাধ্যমকে সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে; জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রথমেই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে এবং এই আইনে বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক সকল নিরপরাধ ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে হবে; অবিলম্বে পণ্যের বাজারে সকল সিন্ডিকেট বিলুপ্ত করতে হবে; কৃষি খাতের বাজার ব্যবস্থাপনা পুনরুদ্ধার করতে হবে; কৃষি খাতে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বীজের যে কোম্পানিকেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, তা রোধ করার উপায় সন্ধান করতে হবে; রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্থানীয় ও অপরাপর বীজ সংরক্ষণ ও বীজ গবেষণা করবে; পক্ষপাতদুষ্ট বিচারব্যবস্থা, পুলিশের অতিরিক্ত ক্ষমতায়ন রোধ, সরকার পতনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, হত্যা, ডাকাতি, লুটপাট বন্ধে পূর্ববর্তী ভুলগুলো সংশোধন করে আমলাতন্ত্র সংস্কার করে জনবান্ধব প্রশাসনিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে; ডিজিএফআই, র্যাব, বিজিবিকে জনবান্ধব করতে করণীয় নির্ধারণ; প্রশাসনিক কাঠামোকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় এবং প্রশাসনে বিদ্যমান সিন্ডিকেট বিলুপ্ত হয়; যত দেশি বিদেশ গোপন চুক্তি আছে সেগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে; দুর্নীতি দমন কমিশন পূনর্গঠন করতে হবে; একটি সেল গঠন করে প্রত্যেকটি প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে দুর্নীতি চিহ্নিত করার একটি স্থায়ী প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা; স্বৈরাচারী সরকারের সময় সংঘটিত দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার; শিক্ষানীতি নিয়ে নতুন একটি টাস্কফোর্স গঠন; বিদ্যমান শিক্ষাক্রম বাতিল, পূনর্বিন্যাস এবং যুগোপযোগী করা; স্বাস্থ্য খাতেও একটি নতুন টাস্কফোর্স গঠন করে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নের রূপকল্প তৈরি; প্রবাসীদের কেবল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হিসেবে না দেখে তাদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা; উন্নয়নের নামে রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালীসহ পরিবেশবিধ্বংসী ও জনস্বার্থবিরোধী নানা অবকাঠামো, শিল্প কারখানা ও প্রকল্প নির্মাণের নামে দখল করে ফেলে রাখা ভূমি, বেদখল হওয়া নদী‑জলাশয়, পাহাড়ে দখল করা ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া এবং সকল অসম প্রকল্প পূণর্মূল্যায়ন; দেশীয় শিল্প যেমন পাট, চিনি, সার, কাগজ, চামড়া বিকাশে করণীয় নির্ধারণ; সবার জন্য জাতীয় নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ এবং এ জন্য একটি স্বচ্ছ উপায় অনুসন্ধান।
মতবিনিময় সভায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থী, বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সংস্কৃতিজন, চলচ্চিত্রকার, নাট্যশিল্পীসহ নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ তাদের মত জানান। শিক্ষক নেটওয়ার্ক সেসব প্রস্তাবের নোট রাখেন এবং এ বিষয়ে নিজেদের মত জানাতে এবং ২০টি চিহ্নিত ক্ষেত্রে এ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহীদের যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানায়।