ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে ঋতুর শুরু গ্রীষ্মকাল দিয়ে। আর গ্রীষ্মকালের নাম শুনলেই আমাদের চোখের পাতায় রৌদ্রদগ্ধ প্রকৃতির ঝলসানো দৃশ্য ফুটে উঠে, যেন গ্রীষ্ম মানেই গরমে হাঁসফাঁস করা এক অতিষ্ঠ সময়। কিন্তু গ্রীষ্ম কী ততটাই তপ্ত মেজাজের? না, বরং গ্রীষ্মেরও আছে বিমুগ্ধ রূপ-রস। গ্রীষ্ম যেমন পারে কালবৈশাখি ঝড়ে সব লন্ডভন্ড করতে পারে, তেমনি নৃত্যরত সবুজ পাতায় ঢেউ তুলে শীতল বাতাসে মন-প্রাণ ঠান্ডা করতে। পারে প্রকৃতিতে নানা রঙের বাহারি ফুল ফুটিয়ে দুপুরের উদাস নির্জনতা, মৌন বিকালকে পরিপূর্ণ করে দিতে।
স্বর্ণাভ সোনালু, বেগুনি রঙের জারুল, রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য যেন হার মানায় ঋতুরাজ বসন্তকেও। তাইতো কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, “কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে/ আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।”
ঠিক তেমনি গ্রীষ্মের এই সময়টাতে ছুটি পেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কৃষ্ণচূড়ার রাঙা রঙে সেজে বসে আছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। যেন লাল মাটির এই ক্যাম্পাস অর্থহীনের ‘এপিটাফ’ গানের সুরে সুরে প্রকৃতিকে বলছে ‘তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল/আমি তো বসে ছিলাম নিয়ে সেই গানের সুর’। কৃষ্ণচূড়ার পাশাপাশি বেগুনি জারুল ও স্বর্ণাভ সোনালু ক্যাম্পাসকে দিয়েছে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। তাছাড়া বিভিন্ন বনজ গাছের সঙ্গে দেশি পাখিদের আনাগোনা ক্যাম্পাসে সৌন্দর্যের এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেইট দিয়ে ঢুকেই সামনের দিকে তাকালে দেখা যাবে গ্রীষ্মের খরতাপে ডালে ডালে যেন আগুন লেগেছে। কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাল লাল ফুলে ছেয়ে গেছে। যেদিকে চোখ যায় যেন সবুজের মাঝে লালের মূর্ছনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর হয়ে হাতের বাঁয়ে আসতেই মুক্তমঞ্চ। এখান থেকেই চোখে পড়ে জারুলের সারি। পাপড়ির নমনীয় কোমলতা, দৃষ্টিনন্দন বর্ণচ্ছটা নিয়ে প্রকৃতিকে আরও সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে এই জারুল ফুল। হেঁটে যাওয়ার সময় জারুলের বেগুনি রং মনে দোলা দেয় না, এমন দৃশ্য বিরল। তপ্ত দুপুরে যখন রোদকে ফাঁকি দিয়ে জারুলের ছায়া ধারে কোনো পথিক হেঁটে যায় তা দেখে জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি লাইন আপনা-আপনিই মাথায় ঘুরপাক খায়– ‘জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায়-রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায়’।
জারুলের বেগুনি দৃশ্য দেখতে দেখতে পথ ধরে এগুতেই ক্যাফেটেরিয়ার সামনে এসে নজরে পড়বে সোনালু। স্বর্ণাভ সোনালু দেখে মনে হবে যেন প্রেমিকার কানের দুল হয়ে দুলছে।
গ্রীষ্মের এই ফুলগুলো এভাবেই পুরো ক্যাম্পাস নানা রঙে সাজিয়ে দিয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম আভায় লাল হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ, প্রশাসনিক ভবন, বিভিন্ন হল ও কাফেটেরিয়া থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত সেই কৃষ্ণচূড়া রোড। এক সময় হয়ত প্রেমিক যুগলের কৃষ্ণচূড়া দেখে স্মৃতিতে ভেসে উঠবে বাংলা গানের সেই বিখ্যাত লাইন—
“এই সেই কৃষ্ণচূড়া
যার তলে দাঁড়িয়ে
চোখে চোখ হাতে হাত
কথা যেত হারিয়ে”
বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হাবিবুল্লাহ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “ঈদের পর এসে ক্যাম্পাসে পা দিয়েই যেদিকে তাকাচ্ছি মনে হচ্ছে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোতে যেন আগুন লেগে আছে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে একেকটা গাছ আর তাতে উজ্জ্বল লাল টুকটুকে ফুল। তাছাড়া এই লালের মাঝে জরুলের বেগুনি আর সোনালুর হলদে রং সেই সৌন্দর্যটা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতিতে আধিপত্য বিস্তার তারাই করছে।”
বাংলা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী সায়মা কাদের বলেন, “ঈদের ছুটিতে এখনো বাড়ি আছি। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া, জারুল ও সোনালু ফুলের ছবি দেখে মন খুবই অস্থির হয়ে আছে। অপেক্ষায় আছি কবে ছুটি শেষ হবে, আর ক্যাম্পাসে গিয়ে এই সৌন্দর্য উপভোগ করব।”