বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিস ইসলামের মা নাজমা ইসলামের আত্মহত্যাকে প্ররোচনামূলক আত্মহত্যা আখ্যা দিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষ বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ‘বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে এ মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে আমার বন্ধু এতিম কেন জবাব চাই জবাব চাই; আমার বন্ধু ঘরছাড়া কেন জবাব চাই জবাব চাই; স্বামী নির্যাতিতা একজন মায়ের সন্তান বলছি; Say no to domestic violence’ ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করতে দেখা যায়।
শিক্ষার্থীরা বলেন, “আমাদের সহপাঠীর (নাফিস ইসলাম) বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তার ভাষ্য অনুযায়ী তার মাকে বেশ কয়েক বছর ধরেই নিয়মিত নির্যাতন করত। গত ৩০ মে তার মা আত্মহত্যা করে মারা যান। তার মায়ের শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তিনি মারা যাওয়ার আগে একটা সুইসাইড নোট লিখেছেন। সেখানে নির্যাতনের কথাও তুলে ধরেছেন। আমরা মনে করি এটি প্ররোচনামূলক আত্মহত্যা। তদন্ত ও যথাযথ বিচার দাবি করছি এবং আমাদের সহপাঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।”
এ সময় বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এ ঘটনায় রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের বাবার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে স্টাটাস দেন নাফিস ইসলাম। সঙ্গে সুইসাইড নোট, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এবং তার বাবার ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস দেন বুয়েটের ওই শিক্ষার্থী।
স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো
“‘পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই।’ -হুমায়ূন আহমেদের তিন ডব্লিউ লেখার এই লাইনটা সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই প্রচলিত। আজকে গল্প শুনাই একজন বাবার, আমার বাবার।”
তিনি লেখেন, “আমার বাবা মো. নুরুল ইসলাম, একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। চাকরিজীবন অনেক সুনামের সঙ্গে পার করেছেন। বাইরের পৃথিবীতে সবাই সম্মানই করতেন। হয়তো তার ব্যবহারে না হলে তার চাকরি সূত্রে পাওয়া ক্ষমতার ভয়ে। আড়ালে চলে তার পৈতৃক গ্রামে সোনা চোরাকারকারী চক্রকে বিভিন্ন পুলিশি সুবিধা প্রদান আর জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থীকে ইউপি নির্বাচনে জেতানোর সব রকম অনৈতিক চেষ্টা।”
তিনি বলেন, “পরিবার জীবনে চিত্রটা আরও ভিন্ন। আমার বাবা-মায়ের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। ছোটখাটো বিষয়ে আমার বাবা মায়ের প্রতি টর্চার ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। মধ্যবিত্ত পরিবারে যেটা হয়, আমার মা সব সহ্য করেই ৩৫-৩৬ বছর সংসার করে গেছেন। আমাদের দুই ভাই-বোনের কথা চিন্তা করে। আমার বাবার অবসরের পর শুরু হয় তার এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার আর মায়ের প্রতি অমানুষিক হিংস্রতা। প্রতিদিনই নেশা করে বাবার সকাল-বিকাল চলত মায়ের ছোটখাটো বিষয় ধরে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে শারীরিক মানসিক নির্যাতন।”
ওই শিক্ষার্থী লেখেন, “করোনার সময় লকডাউনে বেড়ে গেল এই হিংস্রতা অনেক গুণ। সে সময়টুকু আমি বাসায় থাকায় যতটুকু পেরেছি সামলানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের বাসা রাজশাহীতে, আমি বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করি। বড় বোন বিবাহিত, সে শ্বশুড়বাড়ি থাকে। পরিবারের সবাই এই বিষয়গুলো জানত। দাদাবাড়ির সবাই ছিল নীরব, নানাবাড়ির কারও সঙ্গে মাকে যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না।”
তিনি বলেন, “কোনোভাবে পরিবারে স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে না পেরে সমাজের তথাকথিত সিনিয়র সিটিজেনদের কাছে যাই যে আমার মাকে বাঁচান। আমার বাবার সহকর্মীদের কাছে আমি এবং আমার বোন যাই। আইনি হোক অথবা পারিবারিক হোক, কোনোভাবেই সাহায্য করেনি। উপায় না পেয়ে আমার মাকে গত জানুয়ারিতে আমার মামার বাসায় পাঠিয়ে দিই। দুই মাস সেখানেই ছিলেন। এ পর্যায়ে আমার বাবা আমার থাকা-খাওয়া আর পড়াশোনার খরচ বন্ধ করে দেন। পরে পরিবারের একে ওকে ধরে বাবা মাকে ফিরিয়ে আনেন। আর এই আশ্বাস দেন যে আর শারীরিক নির্যাতন করবেন না।”
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “গত ৩০ মে দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে ক্লাসে আমার কাছে একটা ফোন আসে। জানতে পারি মা আর বেঁচে নেই। নিজেকে সামলে দ্রুততার সঙ্গে রাজশাহী আসি। এসে মায়ের মৃতদেহ দেখি। যে ঘরে মা নামাজ পড়তেন, সেই ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে শাড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। আর তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। আমার বোন আরও আগে পৌঁছেছিল। আপু আমাকে জানায় আঘাতের চিহ্নগুলো আরও পরিষ্কার ছিল আপু যাওয়ার পরপর। রাজশাহী চন্দ্রিমা থানার পুলিশ আমার আগেই উপস্থিত আমাদের বাসায়।”
“চন্দ্রিমা থানার অফিসার ইনচার্জ এমরান হোসেন এরপর শুরু করলেন আরেক খেলা। আমার মায়ের শরীরের আঘাতের চিহ্নগুলো মৃত্যুর পর শুইয়ে রাখার জন্য হয়েছে, এ রকম বলতে থাকল। পুলিশের প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্টেও সে রকম লেখা হলো। জানি না, আমার বাবা পুলিশের লোক দেখেই হয়তো পুলিশের এই বিষয়টি এত ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।”
ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, “মাকে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হলো রাত আটটার দিকে। এরপর আমার মায়ের লেখা সুইসাইড নোট খোঁজে পাই আমার ড্রয়ার থেকে। যেখানে আমার মা স্পষ্ট লিখে গেছেন তার সঙ্গে কী কী করা হয়েছিল। রাতেই থানায় যোগাযোগ করলাম অভিযোগের জন্য। ওসি এমরান হোসেন নোট দেখে বললেন, ‘এসব অভিযোগ লাগবে না, অপমৃত্যু মামলার তদন্তেই সব বেরিয়ে আসবে’ আমার বাবা তার চাকরি সূত্রে পাওয়া প্রভাব বা টাকার ক্ষমতা দেখানো শুরু করে ফেলল। পরেরদিন মায়ের দাফন শেষে বাবার গ্রামের সোনা চোরাকারবারি জামায়াতের দল আমাকে বাড়ি থেকে মারধর করে বের করে দিল। আমি আমার বোনের কাছে এসে আশ্রয় নিলাম।”
তিনি আরও বলেন, “আমার বাবার মামাতো ভাই রাজশাহী মেডিকেলের নিউরো মেডিসিনের অধ্যাপকের অনুরোধে মায়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেরি হতে থাকল। এক মাস পর রিপোর্ট পাওয়া গেল। রিপোর্টে মায়ের শরীরে মারধরের চিহ্ন স্পষ্ট। এরপর ওসি এবং তার ইনভেস্টিগেটর অফিসার ঘোরাতে শুরু করল। তারা বলে রিপোর্ট পায়নি। এদিকে বাবা ফোনে আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। রাজশাহী গেলে আমাকে কেটে ফেলে দেবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার পর থানায় করল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেছে। কিন্তু তাদের কিছু করার নেই, কারও বিরুদ্ধে নাকি কোনো অভিযোগ হয় না এগুলোর হিসাবে।”
তিনি আরও বলেন, “দাদাবাড়ির লোকেরা প্রপার্টির লোভে আমাকে দূরে সরাতে পারলে বাঁচে। একঝটকায় আমি পরিবারহীন, বাড়িঘরহীন অনাথ হয়ে গেলাম। অভিযোগের জায়গাটা পর্যন্ত নেই। এমন একটা মানুষে পরিণত হলাম, যার অস্তিত্ব নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আমি থাকা বা না থাকা, একই কথা। শেষ মুহূর্তে আমার মা কেমন অসহায় একা অনুভব করেছিল, সেটা অনুভব করতে পারি। বেঁচে থাকার কোনো কারণ কেন খোঁজে পাননি, কেন বেঁচে থাকতে চাননি বুঝতে পারছি।”
হুমায়ূন আহমেদ তার তিন ডব্লিউ-এ শেষ পর্যন্ত লিখে গেছেন, এখন মনে হয় শীলা বুঝে গেছে—পৃথিবীতে খারাপ বাবাও আছে। যেমন, তার বাবা।