জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় জড়িতদের তদন্তের মাধ্যমে শুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক ও সহপাঠীরা।
সোমবার (১৮ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবিতে
একটি র্যালি বের করেন। র্যালিটি পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। এরপর মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
এসময় শিক্ষার্থীরা ‘বিচার পাওয়ার পরম ভাষা-সুইসাইডই অন্তিম আশা?, অবন্তিকা মরিয়া প্রমাণ করিল—এখানে অভিযোগ মূল্যহীন, আজকে অবন্তিকা-কালকে কে?, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার ভার্সিটি নয়, এই সিস্টেমে ঝুলে পড়াই সেরা সমাধান— সম্বলিত বিভিন্ন পোস্টার ও ফেস্টুন প্রদর্শন করেন।
মানববন্ধনে অবন্তিকার সহপাঠী আব্দুর রহমান বলেন, “অবন্তিকা আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ছিল, পরবর্তীতে সে রি-এড নিলে আমাদের সঙ্গে যখন ক্লাস করতে আসে তখন আমরা আপু করে ডাকতাম। কিন্তু সে নিজেই বলে আমরা ফ্রেন্ড তাই আপনি করে বলা লাগবে না। অবন্তিকা আমাদের বন্ধু এবং সে সব ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু শুধু দুইজনকে না, এর সঙ্গে আরও যারা যারা জড়িত তাদেরও তদন্তসাপেক্ষে শাস্তির আওতায় আনা হোক।”
আরেক সহপাঠী মোস্তফা শন্তু কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ও এমন করবে৷ এখানে এভাবে অবন্তিকার জন্য মানববন্ধন করতে হবে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমরা গত বৃহষ্পতিবারও একসঙ্গে ক্লাস করেছি। তখনো তাকে দেখে কিছু বুঝতে পারিনি। আমরা দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আনিকা বলেন, “এমন স্ট্রং মানুষ কীভাবে আত্মহত্যা করেছে এটাই ভেবে পাচ্ছি না। আমরা এমন একটা মেধাবী শিক্ষার্থীকে হারালাম যে শুধু আইন বিভাগ না পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব ছিল। আমরা চাই একটা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার পেছনে যারা দায়ী তারা বেরিয়ে আসুক। আর কোনো অবন্তিকা যেন এভাবে ঝরে না পড়ে।”
আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নূরনাহার মজুমদার মানববন্ধনে বলেন, “অবন্তিকা আমাদের বিভাগে কোনো লিখিত অভিযোগ করেনি। সে অভিযোগ করেছিল প্রক্টর বরাবর। সে আমাদের মৌখিকভাবে কিছু অভিযোগ করেছিল সহপাঠীদের বিরুদ্ধে। আমরা সেব্যাপারে তাদের সঙ্গে কথাও বলেছি এবং তাদের সতর্ক করা হয়েছে। পরবর্তীতে সে সরাসারি প্রক্টরের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে।”
ছাত্র উপদেষ্টা ইয়াসুনুল কবির বলেন, “অবন্তির অকালপ্রয়াণে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পতন ঘটল। অবন্তিকা শেষ পর্যন্ত তার অবস্থা আমাদের যদি জানাত তাহলে হয়তো আমরা তার মানসিক অবস্থা বুঝে সাহায্য করতে পারতাম।”
এসময় আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সরকার আলী আক্কাস বলেন, “অবন্তিকা অত্যন্ত মেধাবী ছিল, আর কিছুদিন পরেই তার স্নাতক ফলাফল বের হতো। তার ইচ্ছা ছিল বিচারক হওয়ার। সে বিচারক হলে দেশের সম্পদ হতো, সেই অবন্তিকাকে হারানো পুরো রাষ্ট্রের ক্ষতি। অবন্তিকার হত্যার পেছনে যারা আছে তাদের শাস্তির দাবি করছি এই রাষ্ট্রের কাছে।”
এর আগে শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাত ১০টার দিকে জবির আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা ফেইসবুকে শিক্ষক ও সহপাঠীকে দায়ী করে পোস্ট দেন। এর কিছুক্ষণ পরই কুমিল্লার নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস নেন ওই ছাত্রী। আত্মীয় ও পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ওই শিক্ষার্থীর পোস্ট করা সুইসাইড নোটে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, হুমকিসহ নানা অভিযোগ তুলেছেন। আর সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে অফিসে ডেকে নিয়ে হয়রানি ও মানহানির অভিযোগ তুলেছেন। তাছাড়া ‘সেক্সুয়ালি অ্যাবিউজিভ কমেন্ট’ করার অভিযোগ তুলেছেন ওই ছাত্রী।
এ ঘটনার পরপরই বিক্ষোভে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে আগুন জ্বালিয়ে ভোর পর্যন্ত বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তারা। পরে রাত দেড়টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ক্যাম্পাসে এসে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। উপাচার্যের আশ্বাসের পরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থামাননি। পরে জবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠম করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শনিবার (১৬ মার্চ) বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করে।
শনিবার রাতে অবন্তিকার মা বাদী হয়ে কুমিল্লার কোতয়ালী থানায় অবন্তিকার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকি আম্মান ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামসহ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে পুলিশ ওই রাতেই অভিযুক্ত আম্মান ও দ্বীন ইসলামকে আটক গ্রেপ্তার করে।