চরপাড়া মোড়ে অসুস্থ স্বজনের জন্য একটি ডাব কিনতে এসেছিলেন কাজল। তবে দাম শুনে মাথায় হাত! পকেট হাতড়েও পর্যাপ্ত টাকা পেলেন না। ডাবের দাম বৃদ্ধির সম্পর্কে বিক্রেতা জানান, বাগানে এক ধরনের মাছির আক্রমণের কারণে পরিপক্ব হওয়ার আগেই ডাব ঝরে পড়ে। ফলে ফলন কম হয়।
বাগানিদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক গবেষণায় এই সাদা মাছির নতুন প্রজাতি শনাক্ত করেছেন। যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে এই গবেষণার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই গবেষণার প্রধান গবেষক ও বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস এবং সহকারী গবেষক স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. সোহেল রানা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে ২০২৩ সালের মে মাস থেকে এই গবেষণার কার্যক্রম শুরু হয়।
নতুন প্রজাতির সাদা মাছি আকারে ছোট। লম্বায় ১.১ থেকে ১.২ মিলিমিটার। নারিকেলের পরিচিত সাদা মাছির অর্ধেক হলেও প্রজনন ক্ষমতা এবং জলবায়ু সহনশীলতা দ্বিগুণ। এই মাছির সামনের ডানায় আড়াআড়ি চিহ্নযুক্ত ধূসর বর্ণের ব্যান্ড রয়েছে।
অন্য সাদা মাছি যেখানে সুতাকার আকারে ডিম পাড়ে, সেখানে এটি মোম ও তুলা দিয়ে পাখির মতো বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। এদের ডিমে পাতার বোটার মতো অংশ থাকে যা অন্য সাদা মাছিতে দেখা যায় না। এদের পিউপেরিয়াম সমতল এবং কোনো লেজের মতো বর্ধিত অংশ থাকে না। বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে শনাক্ত করা হলেও মলিকুলার অধ্যয়নের কাজ চলমান রয়েছে।
জানা যায়, এই নতুন প্রজাতির সাদা মাছির বৈজ্ঞানিক নাম হলো প্যারালেইরোডেস বোন্দারি এবং বাংলায় বলা হয় বোন্দার নেস্টিং সাদা মাছি।
অধ্যাপক ড. গোপাল দাস বলেন, একসময় গ্রামে গেলেই নারিকেল দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। শীতকালে পিঠা বানাতে এর ব্যবহার ব্যাপক ছিল। তাছাড়া এটি অর্থকরী ফসল হওয়ায় জেলায় জেলায় গড়ে উঠেছিল ছোট শিল্প।
তবে সম্প্রতি নারিকেল উৎপাদনকারীর কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ, মরছে গাছ, কমেছে ফলন। বহু মানুষের জীবিকা নির্বাহ এই নারিকেল শিল্পের সাথে জড়িত। রুগোস স্পাইরালিং হোয়াইটফ্লাই (বৈজ্ঞানিক নাম: আলিউরিডিকাস রুজিওপারকিউলেটাস), যা নারিকেলের সাদা মাছি নামে পরিচিত, এটি একটি বিদেশি পোকা। এই পোকাটি বাংলাদেশের নারিকেল শিল্পে একরকম বিপর্যয় ঘটিয়েছে। নারিকেল চাষীদের সর্বনাশকারী এই সাদা মাছি।
২০১৯ সালে বারির কীটতত্ত্ববিদগণ বাংলাদেশে এর উপস্থিতি শনাক্ত করেন। আমরা দেশব্যাপী জরিপের মাধ্যমে এই পোকার ৬১টি পোষক উদ্ভিদ শনাক্ত করেছি, যা আমেরিকার একটি জার্নালে ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে আমরা এই পোকার বায়ো-ইকোলজি, প্রজাতি সনাক্তকরণ এবং এর ওপর বিভিন্ন জৈব-বালাইনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছি। প্রজাতি সনাক্তকরণের জন্য আমরা দেশের ৩০টি এগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোন থেকে সাদামাছি সংগ্রহ করেছি। গবেষণার ধারাবাহিকতায় যশোর, খুলনা এবং বাগেরহাটের নারিকেলগাছ থেকে সাদামাছি সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়। সেখানেই বোন্দার নেস্টিং সাদামাছির উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
অধ্যাপক গোপাল দাস আরও বলেন, এটি শুধু আমাদের দেশে নয়, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও ক্ষতি করছে। ২০১৮ সালে ভারতের কেরালায় এবং ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে এই মাছি শনাক্ত করা হয়। পরে ২০২৪ সালের প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কায়ও এই মাছির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। আমাদের দেশে এই বোন্দার নেস্টিং সাদামাছির আক্রমণের তীব্রতা এবং ক্ষতির মাত্রা কেমন, সেসব বিষয়ে বিশদ মলিকুলার গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। অজ্ঞাতভাবে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে এবং এর উপকারী পোকাসমূহকে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।