• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঢাবির ​​​​​​​ফল বিপর্যয় নিয়ে শিক্ষাবিদদের অভিমত


সুব্রত চন্দ
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২১, ০৭:৫৭ পিএম
ঢাবির ​​​​​​​ফল বিপর্যয় নিয়ে শিক্ষাবিদদের অভিমত

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রতিবছর বাড়ছে পাসের হার। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা। তবে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়। গত কয়েক বছর ধরে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভর্তি পরীক্ষায় ঘটছে ফল বিপর্যয়।

শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বারবার খারাপ কেন করছে জানতে চাইলে ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ইউনিটে খারাপ ফলাফল করার বড় কারণ হলো—শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারেনি, পরীক্ষা দিতে পারেনি। এমনকি ঠিকমতো লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে অনেকে অসুবিধায় পড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা নিয়মিত লেখাপড়া চর্চা থেকেও দূরে ছিল বিধায় এবার ভর্তি পরীক্ষার ফল বিপর্যয় ঘটেছে।

তবে এমন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়াকে ‘দুঃখজনক’ বলে অবহিত করেছেন ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, “এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় যারা পাস করে আসবে, তাদের মান অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। এখানে এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া দুঃখজনক। এটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ অকৃতকার্য হওয়া এসব শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেও অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবে।”

ভর্তি পরীক্ষার ফল বিপর্যয় কমিয়ে আনার উপায় জানতে চাইলে ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “উচ্চ শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। উচ্চশিক্ষা সবসময় ঐচ্ছিক। যে চাইবে, সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা যাতে কাজে লাগে সেজন্য গোড়া থেকে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে হবে। সেই জায়গায় আমাদের দুর্বলতা আছে। আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা আমরা মুখস্ত নির্ভর করে ফেলেছি। যার কারণে শিক্ষার্থীরা মুখস্ত করে হয়তো জিপিএ ৫ পেয়ে যাচ্ছি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যখন একটু গভীর চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিতে হয়, তখন তারা আর মুখস্ত নির্ভর বিদ্যা দিয়ে পার হতে পারছে না।”

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা কাঠামো নতুন করে ঢেলে সাজানো দারকার জানিয়ে আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, “আমাদের মুখস্ত করে বিদ্যা অর্জন বন্ধ করতে হবে। এই জায়গায় সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা করতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার সুযোগ দিতে হবে, চিন্তার খোরাক দিতে হবে। তাহলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নয়, যতটুকুই তারা লেখাপড়া করবে, ততটুকু তাদের ব্যক্তিগত, পেশাগত ও সামাজিকভাবে কাজে লাগবে।”

ঢাবির ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও বললেন একই রকম কথা। সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, “এটা আগেও দেখা গেছে যে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের মিল পাওয়া যেত না। তবে এবারের মতো ফল বিপর্যয় আগে দেখা যায়নি। এর একটা বড় কারণ হলো করোনার সময় শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। তারা নিজেরাও মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করেনি, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়নি। এমনকি পরীক্ষাও হয়নি।”

এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি খারাপ লক্ষণ মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “আমাদের এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় গিয়েছে সেটার একটা বাস্তবতা এই ফল বিপর্যয়। করোনাকালে বিভিন্ন খাতকে (শিল্প কারখানা, বিদেশে কর্মী পাঠানো, স্বাস্থ্যখাত) যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শিক্ষা খাতকে সেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যার কারণে এই ফল বিপর্যয়টা ঘটেছে।”

এই সমস্যার সমাধান হিসেবে ​অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, “আমাদের পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকরাও যাতে মনোযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করেন এজন্য শিক্ষকদের যথাযথ বেতন-ভাতা ও সম্মান দিতে হবে। তাহলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা সব জায়গায় ভালো ফলাফল করতে পারবে।

ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার দুই ইউনিটের ফল বিপর্যয়ের বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গত বুধবার (৩ নভেম্বর) ঢাবির ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। যেখানে পাসের হার ছিল মাত্র ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বাকি ৮৯ দশমিক ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য হয়। সংখ্যার হিসাবে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৯৪ হাজার ৫০৫ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যে পাস করেছে মাত্র ১০ হাজার ১৬৫ জন শিক্ষার্থী। অকৃতকার্য হয় ৮৪ হাজার ৩৪০ জন।

২০১৯-২১ শিক্ষাবর্ষেও ঢাবির বিজ্ঞান অনুষদের এই ইউনিটে ফল বিপর্যয় ঘটে। সেই বছর পাসের হার ছিল মাত্র ১৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। অকৃতকার্য হয়েছিল ৮৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।

শুধু ‘ক’ ইউনিট নয়, চলতি বছরসহ গত কয়েক বছর ধরে ফল বিপর্যয় ঘটছে কলা অনুষদের ‘খ’ ইউনিটেও। গত মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) প্রকাশিত ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অকৃতকার্য হয় বাকি ৮৩ দশমিক ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী। সংখ্যার হিসেবে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৪১ হাজার ৫২৪ জন। যার মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৭ হাজার ১২ জন এবং বাকি ৩৪ হাজার ৫১২ জন অকৃতকার্য হয়। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষেও এই ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল মাত্র ২৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। সেই বছর অকৃতকার্য হয়েছিল ৭৬ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।

অথচ ২০২০ সালের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ছিল শতভাগ। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন। যদিও মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে পরীক্ষা না হওয়ায় মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার ফল গড় করে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। সেসময় পরীক্ষা ছাড়া পাশের এই ঘটনাটি ‘অটো পাশ’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষা স্বাভাবিক নিয়মেই হয়েছিল। সেই বছর পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ২৮৬ জন।

২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষায়ও পাসের হার ছিল অনেক বেশি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে আগে অনুষ্ঠিত হওয়া পাবলিক এই পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

শিক্ষা বিভাগের আরো খবর

Link copied!