“এখন মনে হয় এগুলো আমি কিভাবে করেছি। আর যখন এসব কথা মনে আসে তখন কান্না চলে আসে। আমার যখন দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের তৃতীয় পরীক্ষা চলছিল তখন আমার প্রসব ব্যথা শুরু হয়। সেদিন কোনো রকম ২ ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়েই আমি হল ছেড়ে বের হয়ে যাই। আমার বাচ্চা হয়। ঐদিন আমার শরীর খারাপ ছিল। কিন্তু পরীক্ষা দিতে আসার সাহস জুগিয়েছে আমার স্বামী ও শাশুড়ি। তারা আমাকে বলেছিলেন অন্তত পাস নম্বরটা যেন তুলে আসি। আমাকে সেদিন নিচতলা থেকে ধরে তৃতীয় তলায় উঠানো হয়। আমিতো ইচ্ছা করলে পরীক্ষা নাও দিতে পারতাম। কিন্তু আমার ছিল অদম্য ইচ্ছা আর তাদের অনুপ্রেরণা। যার ফলে আমি অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী পরীক্ষাগুলো দেই এবং ওই সেমিস্টারে আমি অনেক ব্যবধানে প্রথম স্থান অর্জন করি।
কথাগুলো বলেছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) বিজ্ঞান অনুষদের গণিত বিভাগের ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষের সাবেক শিক্ষার্থী ও একই বিভাগের প্রভাষক মাহিনুর আক্তার।
মাহিনুর ছোটবেলা থেকেই ছিলেন পরিশ্রমী। পড়াশোনার প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। ২০০৩ সালে তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। এরপর ২০০৮ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং ২০১০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ৪ দশমিক ৮০ পেয়ে কৃতকার্য হন। আর তার পরের অধ্যায়টা শুরু হয় কুবিতে। ভর্তি হওয়ার প্রথম বর্ষেই তার বিয়ে হয়। এরপর সংসার, বাচ্চাকাচ্চা ও পরিবারের নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। এসবের মধ্যে দিয়েও তিনি বিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতকে সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়ে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৭’ এবং একই সঙ্গে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ‘চ্যালেন্সর আওয়ার্ড-২০২০’।
তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এতো প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ক্ষান্ত হননি কারণ তার ছিল স্বপ্ন পূরণের অদম্য ইচ্ছা আর সাহস। যে পরিবারে তার বিয়ে হয় সে পরিবার থেকে তার নানা বাধা এসেছে। তার শ্বশুর বাড়ির অনেকে তাকে অনেক কিছু বলতেন কিন্তু তার শাশুড়ি ছিলেন ভালো মানুষ। তিনি তাকে অনেক সাহায্য করতেন। মাহিনুর পড়াশোনার পাশাপাশি বাসার সকল কাজ করতেন। দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির দিনগুলোতে বাবার বাড়ি না গিয়ে স্বামীর বাড়ি চলে যেতেন। তখন তার সামনে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। এসব কাজের ফাঁকে তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হতো। তাছাড়া সংসারে কাজের বাহিরে ছিল সন্তান সামলানো। বাচ্চা যখন কান্না করতো তখন তাকে কোলে নিয়ে পড়তেন আর ঘুমিয়ে গেলে পায়ের ওপর রেখে লিখতে বসতেন। নানা রকম চাপে অনেক রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছে তাকে। সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মাহিনুর সাহসের সঙ্গে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যার জন্য আজ তিনি সফল হয়েছে।
নারীদের উদ্দেশ্যে মাহিনুর আক্তার বলেন, “মেয়েদের বিয়ে হলেই যে তারা তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না এমনটা নয়। তবে এক্ষেত্রে তার স্বামী ভালো হওয়া চাই। আর মেয়েদের হতে হবে ধৈর্যশীল। তাদের নানা প্রতিবন্ধকতা থাকবে; এসব তাদের ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। যখন আমার শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা আমাকে কিছু বলতেন তখন আমি চুপ করে থেকে নিজের কাজ চালিয়ে যেতাম। যদি কোনো মেয়ের অদম্য ইচ্ছাশক্তি, সাহস আর পর্যাপ্ত ধৈর্য থাকে তাহলে সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সে সফল হবেই।”