কুড়িগ্রাম জেলার প্রাচীনতম একটি প্রতিষ্ঠান কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি। ১৮৯৫ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসন ও শহরের বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে জেলার পুরাতন কোর্ট চত্বরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠায় যারা অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে স্থানীয় জোতদার ও ম্যাজিস্ট্রেট যোগেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন অন্যতম।
প্রতিষ্ঠাকালে লাইব্রেরিটির নামকরণ করা হয়েছিল, ‘কুড়িগ্রাম ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরি’। যা তৎকালীন মহকুমা প্রশাসন কুড়িগ্রামের প্রথম জ্ঞানভান্ডার হিসেবে খ্যাত ছিলো। যাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী কালে এই অঞ্চলে বৃদ্ধি পায় জ্ঞান চর্চার।
শুরুর দিকে একটি নিজস্ব ভবন থাকলেও ১৯৩৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় লাইব্রেরিটির স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরে লাইব্রেরিটি তৎকালীন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলের একটি টিনশেড কক্ষে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু আবার বাধ সাধলো বন্যা। ১৯৫৬ সালের বন্যায় কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলটির বিশাল ভবন নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার সঙ্গে লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দ কক্ষটিও ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর স্কুলটি অন্যত্র স্থানান্তর করা হলেও, লাইব্রেরিটি স্থানান্তর করা হয়নি। মাঠের এক কোণে অস্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে লাইব্রেরিটি। অতঃপর নদীর তীর প্রতিরক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা হলে, ধরলা নদী চর ফেলে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে ফিরে যায়। স্কুলটির জমি দখলি সত্ত্ব হিসেবে লাইব্রেরির অধীন হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে লাইব্রেরিটির ব্যাপক সংস্কার করা হয়। সংস্কার করার সময় ‘ভিক্টোরিয়া’ কথাটি বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় ‘কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি’। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লাইব্রেরিটি শহরের প্রাণকেন্দ্র রূপে পরিগণিত হতো। ১০ হাজার বইয়ের জন্য ৩টি বই রাখার আলমারি, ২টি টেবিল ও কিছু চেয়ার দিয়ে ওই সময় চলেছিল এর কার্যক্রম।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লাইব্রেরিটি দখল করে সেখানে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। ওই সময় তারা লাইব্রেরির অনেক বই ও আসবাবপত্র পুড়িয়ে ধ্বংস করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কিছু অনুদান আর স্থানীয়দের উদ্যোগে পুনরায় লাইব্রেরিটি সংস্কার করা হয়। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিভাগ উন্নয়ন তহবিল ও কুড়িগ্রাম পৌরসভার আর্থিক সহায়তায় লাইব্রেরির ৩ রুম বিশিষ্ট ১টি পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়। ১২৬ বছরের এই পুরনো লাইব্রেরিটি কালের সাক্ষী হয়ে আজ স্ব-গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে কুড়িগ্রাম জেলার পুরাতন শহরে।
শত পুরনো, ঐতিহ্যবাহী এই জ্ঞানভাণ্ডরটি বর্তমানে পাঠক সংকট, অবকাঠামোগত সমস্যাসহ নানা সঙ্কটে ভুগছে। লাইব্রেরিটি এখনো পুরোনো ভবনটিতে বিদ্যমান। বর্তমানে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটি দিয়ে লাইব্রেরিটি পরিচালিত হচ্ছে। লাইব্রেরিটির গঠনতন্ত্র মোতাবেক পদাধিকার বলে পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন জেলার জেলা প্রশাসক।
লাইব্রেরিটিতে বর্তমানে বই রয়েছে ৬ হাজার ৫০০টি। প্রতিষ্ঠাকালীন ৪টি বই রাখার আলমারিসহ বর্তমানে ১২টি আলমারি, একটি পাঠ কক্ষ, একটি অফিস কক্ষ ও একটি বঙ্গবন্ধু কর্নার রয়েছ।
একজন খণ্ডকালীন লাইব্রেরিয়ান দিয়ে চলছে এর বর্তমান কার্যক্রম। লাইব্রেরিতে গড়ে প্রতিদিন ৪-৫ জন পাঠক নিয়মিত আসেন। বর্তমানে পত্রিকা না থাকায় ও লাইব্রেরির বাথরুমটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো থাকায় তারাও অনিয়মিত হয়ে পড়ছেন। লাইব্রেরিটি নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা ও বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু লাইব্রেরিয়ানের নিয়মিত বেতন- ভাতা না থাকায় দুই বছর ধরে সকালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এই লাইব্রেরিটি।
লাইব্রেরিতে নিয়মিত আসা কুড়িগ্রাম রিভার ভিউ হাই স্কুলের শিক্ষার্থী রিয়াদ বলেন, “আমি এখানে দু-একদিন পর পর আসি বই পড়তে। আমার জেলার কবি সৈয়দ শামসুল হকের বই পড়তে আমার বেশি ভালো লাগে।”
আরেকজন পাঠক কলেজ শিক্ষার্থী সঞ্জয় সরকার বলেন, “আমি মূলত এখানে পত্রিকা পড়তে নিয়মিত আসি। কয়েকমাস ধরে এখানে জাতীয় পর্যায়ের কোনো পত্রিকা রাখছে না। সব স্থানীয় পত্রিকা এবং এখানের বাথরুমটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। তাই অনেকসময় লাইব্রেরিতে আসতে অনীহা লাগে।”
লাইব্রেরিটির খণ্ডকালীন লাইব্রেরিয়ান নয়ন সরখেল বলেন, “আমি দীর্ঘদিন ধরে এখানে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত। এখান থেকে যে সম্মানী পাই এটি যথেষ্ট নয়। এটি কিছুটা বাড়ালে এবং নিয়মিত হলে আমার জন্য ভালো হতো। এছাড়াও বর্তমানে ডিজিটাল এ যুগে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে লাইব্রেরিটিতে ১টি কম্পিউটার স্থাপন করা খুবই প্রয়োজন। এতে করে লাইব্রেরির বইয়ের তথ্য ও নিয়মিত পাঠকদের তালিকা সংরক্ষণ করা সহজ হতো।”
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কুড়িগ্রাম জেলার আহ্বায়ক ও সংস্কৃতি কর্মী শ্যামল ভৌমিক বলেন, “কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরিটি অনেক প্রাচীন একটি প্রতিষ্ঠান। আগে এখানে প্রচুর পাঠক হতো। কিন্তু বর্তমানের নতুন প্রজন্ম মোবাইল ফোনে আসক্ত হওয়ার কারণে বই পড়তে আর লাইব্রেরিতে যায় না। প্রতিনিয়ত লাইব্রেরিগুলো পাঠকশূন্য হয়ে যাচ্ছে।”
সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিক ইউসুফ আলমগীর বলেন, “কুড়িগ্রামের লাইব্রেরিগুলোতে দিন দিন পাঠকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এতে করে আগের মতো পাঠচক্র ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে না। লাইব্রেরিগুলো চাইলে পাঠকদের বইমুখী করতে নিয়মিত পাঠচক্র, বিতর্ক, কুইজ, রচনা প্রতিযোগিতা, সেরা পাঠক নির্বাচনসহ নানামুখী সৃজনশীল কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।”
কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, “শতবর্ষী এই লাইব্রেরিটি নানা সংকট নিয়ে কুড়িগ্রামে এখনো টিকে আছে। প্রতিদিন এখানে গড়ে ৪-৫ জন পাঠক নিয়মিত বই পড়তে আসেন ও বই বাড়িতে নিয়ে যান। গত বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুদান পেয়ে আমরা বঙ্গবন্ধু কর্নার চালু করেছি। প্রশাসন থেকে সহযোগিতা পেলে আমরা এর অবকাঠামো দিকগুলো আরও সংস্কার করে আধুনিকায়ন করতে পারবো।”