• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভেঙে ফেলা হচ্ছে দেশের প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান


সাব্বির ফকির, খুলনা
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২২, ০২:১৫ পিএম
ভেঙে ফেলা হচ্ছে দেশের প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান

পূর্ব বাংলার প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’। খুলনার মহেশ্বরপাশায় অবস্থিত সেই পুরোনো ভবনটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে নিলাম প্রক্রিয়া। নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে দরপত্র জমা দিয়েছে। তবে স্থানীয় লোকজন ও সংস্কৃতিপ্রেমীরা ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছেন।

১৯২৯ সালে বর্ধমানের মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারিভাবে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই বছরের ১৯ মে ভবনটির উদ্বোধন করেন সে সময়ের খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এইচ কুইনন্টন। ভবনের দেয়ালে থাকা শিলালিপিতেই এসব তথ্য লেখা আছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ জানুয়ারি মহেশ্বরপাশা আর্ট স্কুলটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত কি না, জানতে অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)। এর উত্তরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে লিখিত আকারে জানান, ভবনটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি স্থাপনা। এটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি নয়। 

শশিভূষণ প্রথম এই বাংলায় চিত্রশিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়টির সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাবাহিকতা ও স্থানীয় মানুষের আবেগ সম্পৃক্ত আছে। বিশেষ ব্যক্তিত্বের স্মারক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের জন্য ট্যুরিজম অ্যাক্ট ২০১০ অনুযায়ী সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার স্থানীয় সরকার পরিষদ বা জেলা প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে। সিটি করপোরেশন, স্কুল কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ভবনের সংস্কার সংরক্ষণে কারিগরি পরামর্শ প্রদান করবে।

সরকারি বিএল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক শঙ্কর কুমার মল্লিক বলেন, “এটাই এই বঙ্গের প্রথম শিল্প-শিক্ষা কেন্দ্র। এর সঙ্গে একটা ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জড়িত আছে। এটা অবশ্যই বাঁচানো দরকার।”

মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট ভেঙে ফেলার জন্য দরপত্র আহ্বান করার ঘটনায় বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিশিষ্টজনেরা। ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক যুক্ত বিবৃতিতে এই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বিবৃতিতে তারা বলেন, পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের শিল্পরুচি-বোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্মারক ১৯০৪ সালে শিল্পী শশিভূষণ পাল খুলনার মহেশ্বরপাশায় স্থাপন করেন দেশের প্রথম অঙ্কন শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট। নিজ বাড়িতে এই শিল্প-বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন শশিভূষণ পাল। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯২৯ সালে নিজ বাড়িতে চিত্রশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুরম্য ভবন নির্মাণ করা হয়। এই ভবনটিতে দীর্ঘ সময় আর্ট স্কুলটির কার্যক্রম চলে। বর্তমানে ঐতিহ্যের স্মারক এ ভবনটি ভেঙে ফেলার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আমরা ফেসিলিটিজ অধিদপ্তরের এহেন দায়িত্ব জ্ঞানহীন ঐতিহ্য ও ইতিহাস ধ্বংসের কর্মকাণ্ডে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ভবনটি ঘিরে প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ১৯৭৪ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও কবি জসিমউদদীন এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশের প্রথম অঙ্কন শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়েছিলেন। শিল্পী সুলতান নানা সময়ে এ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছেন। ১৯৮৩ সালে আর্ট স্কুলটি খুলনা শহরে স্থানান্তরিত হয়ে খুলনা আর্ট কলেজ ও বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে খুলনা আর্ট ইনস্টিটিউট হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে। গত শতকে শশিভূষণ পাল নামে একজন শিল্পপ্রেমী মানুষ তার নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের প্রথম চিত্রশিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করে যে নজির স্থাপন করেছিলেন তা আমাদের ইতিহাসের গৌরবের অধ্যায়। নিজ বাড়িতে নিজস্ব চেষ্টায় যে সুরম্য ভবন তৈরি করেছেন তা আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক। সেই স্মারক ভেঙে ফেলার অর্থ হচ্ছে নিজ গৌরবের ইতিহাস থেকে বাংলাদেশকে এবং দেশের জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা।
 

Link copied!