পাবনায় রাসায়নিক সার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষকদের চোখে মুখে বাড়তি খরচে চাষাবাদে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে। আমন চাষের ভরা মৌসুমেও পানির অভাবে সময়মতো ধান রোপণ করতে পারছেন না বিভিন্ন এলাকার কৃষক। সেই সঙ্গে তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে সেচের খরচও।
আমনের ভরা মৌসুমে সারের দাম বাড়ানোর পর হঠাৎ বেড়েছে ডিজেলের দাম। একের পর এক তেল-সারের মূল্যবৃদ্ধিতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পাবনার কৃষকেরা। এমনিতেই এ বছর স্বাভাবিক সময়ের মতো বৃষ্টি হয়নি। এ অবস্থায় যদি অতিরিক্ত দামে ডিজেল কিনে সেচ দিতে হয়, তাহলে কোনোভাবেই লোকসান কাটানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন কৃষকেরা। ফলে আমন চাষ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিজেল ও সারের মূল্যবৃদ্ধির পর আমন মৌসুমে এক বিঘা জমিতে খরচ হবে ৬-৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে ইউরিয়া সারে ৩০ কেজি ৬৬০-৬৮০, পটাশ ১০ কেজি ২৮০, ফসফেট ১৫ কেজি ৪২০, জিপসামে ১০ কেজি ২২০ টাকা খরচ হবে। এ ছাড়া শ্রমিক, হালচাষ ও রোপণ করতে ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং সেচ বাবদ খরচ হবে ১ হাজার ৫০০ টাকা। বিগত মৌসুমগুলোতে এক বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ এবার সার, হালচাষ ও সেচ খরচে অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে প্রায় ২ হাজার টাকা।
জেলার বিভিন্ন মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, বৃষ্টির জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর অবশেষে সেচ দিয়েই চাষাবাদ শুরু করেছেন কৃষকেরা। কেউ জমি প্রস্তুত করতে হালচাষ দিচ্ছেন। কেউবা জমিতে শ্যালো ইঞ্জিনে সেচ দিয়ে ভিজিয়ে রাখছেন। আনুষঙ্গিক কাজ শেষে কেউ আবার চারা রোপণ শুরু করছেন।
ঈশ্বরদী উপজেলার খয়েরবাড়িয়া গ্রামের কৃষক নান্টু মিয়া বলেন, “তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেচ খরচ প্রতি বিঘায় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা বাড়বে এবং হালচাষে খরচ বাড়বে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।”
এ বিষয়ে ট্রাক্টরের মালিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আগে তেলের দাম কম ছিল, চাষের খরচও কম নেওয়া হতো। কিন্তু এবার ডিজেলের দাম বেড়েছে। তাই আগের চেয়ে এবার খরচ বাড়বে।”
পাবনা সদর উপজেলার দোগাছি গ্রামের কৃষক কামরুল মিয়া বলেন, “আমি এ বছর ৪ বিঘা জমির পাট কেটে আমন চাষের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। গত মাসের মাঝামাঝিতে জমিতে পানি না থাকায় এ পর্যন্ত মাত্র এক বিঘা জমিতে ধান রোপণ করতে পেরেছি। তাও আবার সেচ দিয়ে। অন্যান্য বছর এ সময় জমিতে সেচ না লাগলেও এ বছর ধান রোপণের সময় ৩টি সেচ দিতে হয়েছে। চারা বেড়ে ওঠার সময় ৬টি সেচ দিতে হচ্ছে। অন্যান্য বছর চারা রোপণ থেকে শুরু করে কাটার আগপর্যন্ত ৬টি সেচ দিতে হলেও এ বছর ১০ থেকে ১২ বার সেচ দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “গত বছর এক বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে খরচ হয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। এ বছর লাগছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেচের খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।”
আটঘরিয়া উপজেলার শ্যালো পাম্প মালিক আরাফাত মিয়া বলেন, “এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে ৩ লিটার ডিজেল প্রয়োজন হয়। এক লিটার ডিজেলের এখন ১১৪ টাকা। তেলের খরচের পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেছে। এ ছাড়া কাছাকাছি পানির ব্যবস্থা না থাকায় দূর থেকে পানি টেনে আনতে খরচও অনেক বেশি হচ্ছে। ফলে সেচের খরচ বাড়ছে।”
সাঁথিয়া উপজেলার আমন চাষি রহিম প্রামানিক বলেন, “কর্জ করে ২ বিঘা জমিতে আমনের আবাদ করেছি। উৎপাদন খরচ উঠবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছি। সেচের খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারের দাম ও শ্রমিকের খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমনের উৎপাদন নিয়ে বিপাকে রয়েছি। এদিকে বিদ্যুৎ-চালিত ডিপ টিউবওয়েলের খরচও বেড়ে গেছে।”
সুজানগর উপজেলার মাসুদ মল্লিক বলেন, “গত বছর এ সময় প্রতি মাসে ডিপ টিউবওয়েলের বিদ্যুৎ বিল লাগত ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এ বছর এ সময় বিদ্যুৎ বিল ১৫ হাজার টাকার বেশি লাগছে। প্রতি বিঘা জমির প্রায় ২০ শতাংশ ফসল ডিপ টিউবওয়েল মালিককে দিয়ে দিতে হচ্ছে।”
আমন আবাদ নিয়ে কোনো সংশয় নেই বলে দাবি করেছেন পাবনা জেলা কৃষি কর্মকর্তা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ড. মো. সাইফুল আলম বলেন, “এ বছর পাবনায় ৫৫ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ দশমিক ৬৭ লাখ টন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমন চাষের মোক্ষম সময় হলেও আগস্টের শেষ পর্যন্ত আবাদ করা যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “ইতোমধ্যে অর্ধেক জমিতে আমন আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। বৃষ্টি কম হওয়ায় ফসল উৎপাদনে এবার ব্যয় কিছুটা বাড়বে।