জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর ১৯৯৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারোঘরিয়া ইউনিয়নের চামাগ্রাম গ্রামে কয়েকটি কূপে পরীক্ষা চালিয়ে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি পায়। এরপরই সেই গ্রামের মানুষের জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে আসে ‘ব্রতী’ নামের একটি সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে কিভাবে বাংলাদেশে প্রথম আর্সেনিক শনাক্ত গ্রামের বাসিন্দাদের আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ দেওয়া যায়।
গ্রামবাসীর জন্য আর্সেনিক পানির ভয়াবহতা দূর করতে ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ দিতে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে প্রাকৃতিক উপায়ে ফিল্টার করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে ব্রতী। বর্তমানে তারা বারোঘরিয়া ইউনিয়নের চামাগ্রাম, লাহারপুর ও লক্ষীপুর গ্রামের প্রায় পাঁচশ পরিবারে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে।
ব্রতী পানি বিশুদ্ধ করতে প্রয়োগ করছে প্রাকৃতিক পদ্ধতি। পাথর ও বালু দিয়ে নদীর পানি বিশুদ্ধ করে সরবরাহ করছে আশেপাশের ৩টি গ্রামে। নদী থেকে সংগ্রহ করা ফিল্টার পানি গ্রামের মানুষেরা খাবার পানি ছাড়াও রান্না ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করছে। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে নদীর পানি বিশুদ্ধ করে সরবরাহ করায় দেশের প্রথম আর্সেনিক শনাক্ত গ্রামের চিত্র পাল্টেছে। ব্রতীর এই কার্যক্রমের ফলে বর্তমানে গ্রামটিতে কেউ নতুন করে টিউবওয়েল স্থাপন করছে না।
জানা যায়, ব্যয়বহুল খরচের এই পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটির কোনো লাভ না হলেও ব্যাপক সুবিধা পাচ্ছে ৩টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রথম আর্সেনিক শনাক্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা এর ঝুঁকিতে আছে। এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে আর্সেনিকের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ ছড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে জেলা জুড়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদীর পানি সংগ্রহ করে ব্রতীর মতো প্রাকৃতিক উপায়ে বিশুদ্ধ করতে পারলে রক্ষা পাবে এই অঞ্চলের মানুষ।
এ বিষয়ে চামাগ্রামের সাইদুর রহমান বলেন, দেশের মধ্যে এই গ্রামে প্রথম আর্সেনিক ধরা পড়ার পর ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক গ্রামের আর্সেনিকের অবস্থা দেখতে আসেন। এরপর তিনি গ্রামবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার উদ্যোগ নেন। মহানন্দা নদী থেকে পাইপ দিয়ে আধা কিলোমিটার দূরে তাদের অফিসের পাশে পানি ফিল্টারের জায়গায় পানি উঠিয়ে নিয়ে যায়। এরপর পানি ফিল্টার করার পর বাড়ি বাড়ি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করেন তারা।
তিনি আরও বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ব্রতীর সরবরাহ করা পানি ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ। তবে আগে পানির বিল ১২০ টাকা ও সংযোগ নিতে ১৫০ টাকা লাগতো। তবে এখন তা বাড়িয়ে পানির বিল ৩৫০ টাকা ও সংযোগ ফি ৪০০ টাকা করা হয়েছে। এতে গ্রামবাসীর একটু কষ্ট হচ্ছে।
গত ১০ বছর ধরে ব্রতীর পানি ব্যবহার করে একরামুল হকের পরিবার। একরামুল হকের স্ত্রী আকলিমা বেগম জানান, এই পানি পাওয়ার পর থেকে আমরা টিউবওয়েল বা কুয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের জন্য খুবই ভালো হয়েছে। যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় পানি সরবরাহ পাচ্ছি। রান্নাসহ সব কাজে এই পানি ব্যবহার করতে পারি।
লাহারপুর গ্রামের রঞ্জনা দাস বলেন, টিউবওয়েলের পানিতে প্রচুর পরিমানে আয়রন আছে। থালা বাসন, এমনকি কাপড়ও লাল হয়ে যায়। তাই আমরা এসব পানি বাদ দিয়ে নদীর সরবরাহ করা ব্রতীর পানি ব্যবহার করি। এই গ্রামে বর্তমানে টিউবওয়েল বসানো যায় না। কারণ এর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। এই পানিতে ভাত রান্না করলে ঝরঝরা হয় বলে জানান গৃহিনী শাহনাজ বেগম।
স্থানীয় এনজিওকর্মী নাদিম হোসেন জানান, বর্তমানে ব্রতীর ফিল্টার করা পানি ব্যবহার আশেপাশের কয়েকটি গ্রামেও বাড়ানো যেতে পারে। তাতে সেসব এলাকার মানুষ আর্সেনিক থেকে রক্ষা পাবে। এই পদ্ধতিতে নদীর পানির সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা- ব্রতীর ফিল্ড ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম বলেন, “১৯৯৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চামাগ্রামে আর্সেনিক শনাক্তের পর থেকেই ব্রতী এই এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে কাজ শুরু করে। এরপর থেকে সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রায় পাঁচশ পরিবারে পানি সরবরাহ করছি আমরা। আগামীতে পানি সরবরাহের পরিমান আরও বাড়ানো হবে।”
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই কার্যক্রমকে মডেল হিসেবে নিয়ে আর্সেনিক প্রবণ এলাকায় এমন কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে আমাদের। এই কাজে সরকার বা অন্য কোনো সংস্থা এগিয়ে আসলে তাদেরকে সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে ব্রতীর। আমাদের শিল্প পর্যায়ে বৈদ্যুতিক বিল দিতে হয়। এটি যদি কৃষি বা কোনো উপায়ে দেওয়া যেত তাহলে প্রকল্পটি আরও দীর্ঘস্থায়ী করা যেত। খুব সহজেই পানি পাওয়া যায় বলে এর কদর কম। অপচয় করা হয় অনেক। তাই সরকার যদি ভুর্তকি দেয় তাহলে পানির মিটার স্থাপন করা সম্ভব হবে।
বলা হয়, আর্সেনিক সিরিঞ্জ দিয়ে কারো দেহে আর্সেনিক পুশ করলে সেই ব্যক্তি স্বল্প সময়ের মধ্যে মারা যাবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম রাব্বানী জানান, আর্সেনিকের প্রভাবে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। চামড়ায় সাদা ফোটা ফোটা দাগ হয়ে থাকে। চুল উঠে যায়, ফুসফুসের সমস্যা দেখা যায়। লিভারের বিভিন্ন সমস্যা ও শ্বাসকষ্ট হয় আর্সেনিকের কারণে। আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহারে যত দিন যায়, তত সমস্যা বাড়তে থাকে। তাই নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার সরকার বলেন, সরকার নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে নানা পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে যেই এলাকার জন্য যেমন প্রযুক্তি দরকার, তেমনি প্রযুক্তি সম্পন্ন পানির উৎস দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও প্রত্যেক উপজেলায় পানির উৎস বিবেচনায় একটি করে স্কিম করা হচ্ছে। এতে ওই এলাকার মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় পানির গুনগতমান পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী ফিল্টার দেওয়া হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গত ৩ বছরের তথ্য অনুযায়ী সদর উপজেলায় ২১ শতাংশ টিউবওয়েলে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। শিবগঞ্জ ২৫ শতাংশ ও গোমস্তাপুরে ৮ শতাংশ টিউবওয়েলে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। তবে ভোলাহাট ও নাচোল উপজেলা এখনও আর্সেনিকমুক্ত রয়েছে। বর্তমানে আরেকটি জরিপ কাজ চলছে, এটি শেষ হলে জেলা জুড়ে আর্সেনিকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে।
অমিত কুমার সরকার আরও বলেন, “আমাদের সাধারণত ইউনিয়ন ভিক্তিক বরাদ্দ আসে। এগুলো উপজেলা চেয়ারম্যান ও এমপি মহোদয় দিয়ে থাকেন। তাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে দেশের প্রথম আর্সেনিক শনাক্ত হওয়া বারোঘরিয়ার চামাগ্রামে বরাদ্দ দেওয়ার। তারা জানিয়েছেন, এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। কারণ এখানে আর্সেনিকের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই পাইপ ওয়াটার প্রকল্প আসলে সেই গ্রামে দেওয়া হবে।”
চামাগ্রামে ব্রতীর মতো এভাবে নদীর পানি সংগ্রহ করে বিশুদ্ধ করে সরবরাহ করতে পারলে তা খুবই ভালো ও পরিবেশবান্ধব হবে বলে জানান তিনি।