অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাড়তি টাকা দিলেই ভুল সঠিক হয়ে যায়। না দিলে আবেদন ফরমে ভুল আছে দাবি করে চলে দিনের পর দিন হয়রানি। এভাবে চলতে থাকা লালমনিরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ঘুষ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। হয়রানির শিকার পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের অভিযোগও আমলে নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
বিদেশে কর্মসংস্থান কিংবা চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্টের জন্য ছুটে যেতে হয় পাসপোর্ট অফিসে। দ্রুত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে জরুরি ফি প্রদান করে আবেদন করেন গ্রাহকরা। কিন্তু সময়মতো পাসপোর্ট না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকা গুনতে হয় গ্রাহকদের। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়তি টাকা আদায় করছেন। টাকা না দিলে আবেদন ফরমে ভুল আছে দাবি করে দিনের পর দিন হয়রানি করতে থাকে পাসপোর্টপ্রত্যাশীদের। এভাবে লালমনিরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ঘুষ বাণিজ্য এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, ২০১৩ সাল থেকে ৯ বছর ধরে একই অফিসে কর্মরত থাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাবুল মিয়া। অফিসের কর্মচারী আনোয়ার হোসেন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাবুল মিয়ার মাধ্যমেই চলে অফিসের ঘুষ-বাণিজ্য। অনলাইনে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে অফিসে কাগজ জমা দেওয়ার পর থেকে শুরু হয় সেবাপ্রত্যাশীদের বিড়ম্বনা। পাসপোর্টপ্রত্যাশীরা অফিসে প্রবেশ করলে অফিসের কর্মকর্তাদের নির্দেশেই বাবুল ও আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাদের হাতেই হয় লেনদেন। পরে অফিস শেষে সেই ঘুষের টাকা পৌঁছে যায় নিচতলা থেকে ওপরতলা অবধি। তাদের দাপটে যেন নিশ্চুপ অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তারাও।
জানা গেছে, সম্প্রতি ওই পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহায়ক আনোয়ার হোসেন পাসপোর্ট প্রদানের সময় হারুন-অর-রশিদ নামে এক স্কুলছাত্রের কাছে ১৫০০ টাকা দাবি করেন। ওই ছাত্র ঘুষ চাওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল করে। পরে বিষয়টি নিয়ে জেলাজুড়ে সমালোচনার শুরু হয়।
আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের দুবাইপ্রবাসী রাশেদা বেগম (৪০) বলেন, “আমার পাসপোর্ট বই হারিয়ে যায়। পরে থানায় জিডি করে অফিসে যাই। অফিসে ঢোকামাত্রই পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাবুল মিয়া এসে আমার কাছে এক হাজার টাকা চায়। বলে, টাকা দিলে দ্রুত কাজ হয়ে যাবে। না দিলে পাসপোর্ট বই পেতে সময় লাগবে।”
অনলাইনে আবেদনের পর কাগজ জমা দিতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, “এক সপ্তাহ থেকে ঘুরছি। জমা নিচ্ছে না। সকালে বলে দুপুর ১টায় আসেন, দুপুরে আসলে বলে স্যার নেই। পরে গত রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাবুল মিয়াকে বাড়তি এক হাজার টাকা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই আবেদনটি জমা নেন।”
হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা এলাকার সাজু মিয়া জানান, মায়ের চিকিৎসায় ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত পাসপোর্ট প্রয়োজন। অনলাইনে আবেদন করেছি, কিন্তু বাবার নামের জায়গায় মোহাম্মদ বসে গেছে। আর এই ভুলটির জন্য পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা আবেদন ফরম ও ফি জমা দিচ্ছিলো না। পরে বাড়তি এক হাজার টাকা দিলে আবেদনটি জমা নেন।
জানা গেছে, লালমনিরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাবুল মিয়া ও অফিস সহায়ক আনোয়ার হোসেনের নিয়ন্ত্রণে পুরো পাসপোর্ট অফিস। টাকা ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন জমা নেন না তারা। ১৫০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা দিলে এক দিনেই আবেদনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে দেন তারা। টাকা দিতে না পারলে শুরু হয় গ্রাহক ভোগান্তি। আবেদনে নানা ধরনের ভুলত্রুটির কথা বলে দিনের পর দিন হয়রানি করা হয়। শেষে বাধ্য হয়ে একসময় হার মেনে নিয়ে ঘুষ দিয়ে পাসপোর্ট নেয় গ্রাহকরা।
লালমনিরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী আনোয়ার হোসেন ও অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাবুল মিয়া অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য আবেদন জমা নিয়ে কোনো টাকা নেই না। তবে খুশি হয়ে কেউ টাকা দিলে সেটা গ্রহণ করেন বলেও তারা স্বীকার করেন।
লালমনিরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ জানান, ওই দুই কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।